বেকার থাকলেও দক্ষ কর্মী নাই ! banglardarpan.com

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২৭ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার।

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের বড় ১০টি খাত হচ্ছে- তৈরি পোশাক, বস্ত্র, নির্মাণ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হেলথ কেয়ার, তথ্য-প্রযুক্তি, পর্যটন, চামড়া, হাল্কা যন্ত্রাংশ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এসব খাতের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। জাতীয় অর্থনীতির হিসেবের বাইরেও এ কর্মসংস্থাগুলোতে কাজ করে চলে হাজারও কর্মীদের জীবিকা। আশার কথা, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ সম্ভাবনাও রয়েছে।

২০১৭ সালের মধ্যে আইটি খাতে নতুন করে ৫০০ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করবে, ২০২০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৬০০তে। একইভাবে ২০১৭ সালে হাল্কা যন্ত্রাংশ শিল্পে ১০-১২টি, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চারটি, চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার শিল্পে ২০টি, নির্মাণ শিল্পে ৮০০টি ও তৈরি পোশাক শিল্পে ২৪০টি কারখানা গড়ে উঠবে। ২০২০ সালে হাল্কা প্রকৌশল শিল্পে ১৫-২০টি, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ছয়টি, চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার শিল্পে ২৫টি, নির্মাণ শিল্পে ৯০০টি ও তৈরি পোশাক শিল্পে ৩১০টি কারখানা নতুন করে যাত্রা শুরু করবে।

দেশে বেকারত্ব কমানোর লক্ষ্যে এসব কর্মসংস্থান আশার আলো দেখালেও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আতঙ্কের কারণ হলো, দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের ভিত্তিমূল্যে ২০০৬ সালে একজন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা ছিল ৯৬ হাজার ৬৩০ টাকা, যা ২০১০ সালে বেড়ে হয় এক লাখ সাত হাজার ১৩৭ টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার ৫২৭ টাকা। এই সময়ে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা আগের সমানই ছিল।

অর্থাৎ এই সময়ে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা খুব একটা বাড়েনি। বেশির ভাগ খাতেই সময়ের ব্যবধানে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিন্তু শিল্প খাতে শ্রমিক প্রতি জিডিপি কমে গেছে, যা খুবই বিপদের বিষয়। দেশে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ঝোঁক বাড়ছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা গড়ে উঠছে না। আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে, তার সঙ্গে শিল্প খাতের চাহিদার কোনো সামঞ্জস্য নেই। আর উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে কোনো একটি কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া বা ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার আগ্রহ থাকে না। ফলে শিল্প খাতে এসব উচ্চশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক হিসেবেও নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। ফলে শিল্প খাতে শিক্ষিত শ্রমিকের সংকট রয়েছে।

চাহিদা ও যোগ্যতার এই ফাঁরাকের কারণ ব্যাখ্যা করে বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলছেন, উচ্চশিক্ষায় সনদ পাওয়া আমাদের শিক্ষার্থীরা শিল্পের উৎপাদন, বিপণন পর্যায়ে চাকরি করতে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ সরকারি চাকরি, ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের কাজ। কিন্তু চাকরির বাজারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে একটি শিল্প স্থাপিত হলে সেখানে কর্মকর্তা পর্যায়ে যদি ১০ জন লোক নিয়োগের দরকার হয়, দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় শতাধিক। উচ্চশিক্ষায় অতি ঝোঁকের ফলে উচ্চশিক্ষিতরা কর্মকর্তা পদে চাকরি না পেয়ে বেকার থাকছে, অন্যদিকে শিল্প কারখানাগুলো শ্রমিক সংকটে ভুগছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বেকার তৈরির কারখানা হিসেবে আখ্যা দিয়ে করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা অনার্স-মাস্টার্স পাস করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাকরিও পাচ্ছে না, আবার দক্ষতার অভাবে কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও ভালো করতে পারছে না। সরকার এরই মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছে, যার কোনো প্রয়োজনই নেই। বরং শ্রমিকদের সামাজিকভাবে সম্মান করা শিখতে হবে। আরো বেশি কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ’

দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও, তৈরি পোশাক, বস্ত্র খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন বলে অনুমান করা হয়। এর মধ্যে ভারতীয়ই আনুমানিক পাঁচ লাখ এবং তারা শুধু ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা ইংল্যান্ড থেকে ভারতীয়দের আসা রেমিট্যান্সের প্রায় সমান। আর বাংলাদেশ বিশ্বের যে ৩০টি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পায়, সেই তালিকায় ভারত নেই। এই ৩০টি দেশের মধ্যে ইরান রয়েছে, যেখান থেকে বছরে রেমিট্যান্স আসে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভারত থেকে আমাদের রেমিট্যান্স আসে আরও কম।

চাকরিদাতারা খুঁজছেন দক্ষ ও যোগ্য প্রার্থী। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে পদভেদে হাজার হাজার, এমনকি লাখো আবেদন পড়ে। কিন্তু পছন্দমতো যোগ্য প্রার্থী অনেক সময়ই পান না তাঁরা। অথচ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাবেই দেশে বেকার ও আংশিক বেকারের সংখ্যা প্রায় ৭১ লাখ। স্নাতোকত্তর পাস কোনো কোনো বেকার অষ্টম শ্রেণি পাসের চাকরির জন্য আবেদন করেন, এমন কথাও শোনা যায়। উল্টো দিকে দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেশের প্রধান প্রধান শিল্প খাতগুলো। দেশের মোট আটটি খাতে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে শ্রমিক কম রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার। সঙ্গে রয়েছে মধ্যম সারির কর্মকর্তার সংকটও। ফলে অনেক বেশি বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে আনতে হয়।

উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন একই সঙ্গে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মী। সমীক্ষামতে, বাংলাদেশে অশিক্ষিত শ্রমিকের হার দিন দিন কমছে। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এইচএসসি পাস বা তার বেশি শিক্ষিত শ্রমিকের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮.৯ শতাংশে উঠেছে। আরো সমস্যা হচ্ছে, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এটি বাড়ানো সম্ভব।

দেশের ১০টি খাতে নিয়োজিত জনবলের মোট শ্রমশক্তির ৮ দশমিক ৭ শতাংশ বা সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্পে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নির্মাণ শিল্প ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও তৃতীয় অবস্থানে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

১০টি খাতে কর্মরতদের ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশেরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আর দেশের সব খাতে কর্মরতদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৪ শতাংশেরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমশক্তির মাত্র ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা পাঁচ লাখ ৭৪ হাজারের কারিগরি বা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ রয়েছে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল মোটে ৮০ হাজার। গবেষণায় এটি স্পষ্ট যে বিভিন্ন কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ নেওয়াদের মধ্যে বেকারত্বের হার সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের তুলনায় খুবই কম। ২০০৬ সাল থেকেই কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশিরা উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ালে বিদেশিদের ওপর শিল্প মালিকদের নির্ভরতা এমন থাকবে না।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিভিন্ন খাতে মোট আট কোটি ৮৭ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। এই সময় পর্যন্ত দেশের ৯টি শিল্প খাতে নিয়োগ দিতে হবে আরও এক কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার নতুন শ্রমিক। তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক লাগবে ৮০ লাখ, আধাদক্ষ ৫৬ লাখ, অদক্ষ শ্রমিক লাগবে ৩১ লাখ। ৮০ লাখ দক্ষ শ্রমিকের জোগান নিশ্চিত করতে হলে আগামী আট বছরে ৫৬ লাখ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষিত বেকাররা প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে বেকারত্ব যেমন ঘুচবে, ঘটবে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। তা না হলে উভয় সংকটে ভুগবে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদ (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিআইডিএসের ১৮ জন গবেষক ‘বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও দক্ষতার ঘাটতি’ শিরোনামে সমীক্ষাটি সম্পন্ন করেছেন।

বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে তাদের বিভিন্ন শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনের সুপারিশ করে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ জন্য উচ্চশিক্ষা কারিকুলামেও পরিবর্তন আনা জরুরি। সমীক্ষা দলের সদস্য ও বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ১০টি খাতের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সমীক্ষাটি করা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয়েছে, ভবিষ্যতে কোন খাতে কি পরিমাণ জনবল লাগবে। সরকার ও বেসরকারি খাত এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে পারে। আর চাকরিপ্রার্থীরাও নিজের পছন্দ মতো প্রশিক্ষণ নিয়ে সহজেই চাকরি পেতে পারেন। ড. নাজনীন বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানকার শিক্ষিতরা ‘হোয়াইট কলার জব’ বা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি পেতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা পাল্টে গেছে।

এখন বাংলাদেশ শুধু নয়, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোতেও কর্মকর্তার বদলে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। তিনি জানান, একজন দক্ষ শ্রমিক মাঝারি মানের কর্মকর্তার চেয়েও বেশি বেতন পাচ্ছে। রং তৈরির কারখানায় যিনি সঠিকভাবে রং মেশাতে পারেন, তাঁর বেতন হয়তো আমার চেয়েও বেশি। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে বেকার যুবক তথা বেকারদের নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালে দেখা যায় বেকারদের চিত্র। বেকার নিয়ে সব সময় ক্ষমতাসীনদের দোষারোপ করা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের বেকাররা কতটা দক্ষ? কতটা কর্মঠ?

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক সনদকে উপলক্ষ করে বেকার সাজানো হয়। কিন্তু শুধু সনদ থাকলে হবে না। প্রতিটা সনদধারী তাদের আগ্রহ কাজে কিংবা চাকরিতে দক্ষ ও পারদর্শী না হয় তবে প্রতিষ্ঠান অবশ্যই তাকে কাজের সুযোগ দিবে না। অবশ্যই দক্ষ কর্মীই নেবে প্রতিষ্ঠান। সুতরাং সনদের সঙ্গে প্রতিটা কর্মহীনকে কারিগরী শিক্ষা ও আগ্রহ কাজে প্রশিক্ষণ নিতে হবে তবেই দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ যোগদান করে দেশের বেকার সমস্যা সমাধান করা যাবে। অন্যথা দিনের পর দিন দেশে বেকার সমস্যা বাড়তে থাকবে এবং হুমকির মুখে পড়বে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *