রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন বিষয়ে সতর্ক বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া

বাংলার দর্পন ডটকম :

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠনগুলো সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে সোমবার নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশে ও মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাবে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে সোমবার পর্যন্ত চার লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

রাখাইনের সহিংসতায় মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকেদর পাশাপাশি আরসা সদস্যরাও বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে- এমন খবরে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের প্রশাসন। সম্প্রতি এ বিষয়ে কক্সবাজারে একটি জরুরি বৈঠক করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্য  বলেন, “আমাদের কাছে তথ্য আছে, আরসা সদস্যরা বাংলাদেশে এসে পুরাতন রোহিঙ্গাদের মাঝ থেকে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ করছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশীয় কিছু জঙ্গিও তাদের মদদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের পলিসি কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেওয়া নয়, এজন্য আমাদের বেশ কয়েকটি শক্তিশালী টিম কক্সবাজারসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করছে।

“রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরসাও আমাদের জন্য বিরাট মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে মালয়েশিয়ার একটি দল ইতিমধ্যেই “রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করার জন্য মিয়ানমার চলে গেছে” বলে কুয়ালালমপুরে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার নতুন পুলিশ প্রধান।

“মালয়েশিয়ার একটি দল সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে গিয়ে লড়াই করার জন্য সেখানে যাবার চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। কাউন্টার টেররিজম চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যে, এদের কতজন ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়েছে আর কতজন এখনো যাবার চেষ্টায় আছে,”  বলেন মালয়েশিয়া পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ ফুজি হারুন।

“রাখাইন এবং মালয়েশিয়ায় থাকা বিদ্রোহীরাই এইসব জিহাদিদের নিয়োগ করছে। আমাদের ধারণা, যারা সেখানে (রাখাইন) গেছে, তারা বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড হয়ে সেদেশে প্রবেশ করেছে,” যোগ করেন তিনি।

জীবন দিতে হলে দেবো :

রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন একজনের  বলেছে, যিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও নিজে আরসার সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছেন।

“আমি অস্ত্র পাইনি। আমি আল ইয়াকিনের বড় নেতা নই। আমি একজন ছোট যোদ্ধা।”

উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে নিজেকে আবদুস শুকুর পরিচয় দেওয়া ১৮ বছরের তরুণ এভাবেই আরসার সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়  বর্ণনা করেন। তবে আরসাকে তিনি এর পুরোনো নাম ‘হারকা আল ইয়াকিন’ হিসেবেই উল্লেখ করেন।

“আমি আমার নিজের দেশে আবার যাব, যুদ্ধ করতে হলে করব। আমার দেশকে আজাদ করতে জীবন দিতে হলে দেবো,”  বলেন রাখাইনের মংডুর ঝুলাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা শুকুর।

শুকুর জানান, তাঁর গ্রামে প্রায় ৪০ জন আল ইয়াকিন সদস্য ছিলেন, যারা রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছিলেন।

স্থানীয় মগরা সেখানে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন জমিরও ভাড়া আদায় করে বলে জানান শুকুর।

“নিজের দেশে নিজের জায়গায় আমরা বসতি করতে পারিনি। আমরা কাজ করতে পারি না। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পারি না। টাকা দিতে হয়। আল ইয়াকিন ওইসব রোহিঙ্গাদের ভালোর জন্য কাজ করে, যাতে মানুষরা সুন্দরভাবে থাকতে পারে, দুমুঠো খেতে পারে,”  বলেন শুকুর।

জঙ্গিরা সুযোগ নিতে পারে :

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের জাতিগত নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য লড়াই করার দাবি করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে আরসার হামলার প্রেক্ষিতেই আগস্টের ২৫ তারিখ সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নিপীড়নের সূত্রপাত হয়।

২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যের পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার জন্যও দলটিকে দায়ী করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তখন দলটি আল ইয়াকিন নামে পরিচিত ছিল।

জাতিসংঘের হিসাবে, ওই বছরের সহিংসতায় রাখাইন রাজ্য থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ৮ লক্ষ থেকেও বেশি।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ এর গত বছরের এক প্রতিবেদন মতে, আল ইয়াকিন সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিল সৌদি আরবে বসবাসকারী একদল রোহিঙ্গা, যাদের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও সম্ভবত ভারতের সাথে যোগাযোগ ছিল।

এদিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদা গত সপ্তায় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের পক্ষে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে ১৪ সেপ্টেম্ব আল কায়েদা বা এ ধরনের আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে এক বিবৃতিতে জানায় আরসা।

“রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটের সুযোগ নিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করতে পারে কেউ” গত সপ্তায় এ রকম এক সতর্কবাণী করেন বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, “রোহিঙ্গাদের স্বার্থে তাঁদের ক্যাম্পের ভেতরে থাকার অনুরোধ করেছি আমরা।… ত্রাণের আড়ালে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার ঘটনা ঘটতে পারে।”

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে সোমবার ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজত এ ইসলাম প্রায় বিশ হাজার মানুষের এক বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকায়।

“আমরা ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাস অবরোধ করে মিয়ানমার সরকারকে এই বার্তা দিতে চাই যে, আরাকানে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা আমরা বরদাশত করব না,” বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন বিক্ষোভকারী মওলানা সাইফউদ্দিন।

হাজারো স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত :

পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ইসলামি চরমপন্থী সংগঠন ইসলাম ডিফেন্ডার ফ্রন্ট (এফপিআই) এর এক নেতা জানান, তাঁদের ‘অন্তত দশ হাজার’ সদস্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করতে প্রস্তুত।

“এফপিআই সব সময়ই অন্য মুসলমানদের সহযোগিতা করার বিষয়ে সক্রিয়,” বেনারকে বলেন সংগঠনটির জাকার্তা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক নভেল বামুকিন।

দলটির সদস্যরা মিয়ানমার যেতে না পারলেও বাংলাদেশ গেছে বলে জানান তিনি।

তবে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (বিআইএন) এর মুখপাত্র ওয়ায়ান পুরওয়ান্ত ফ্রি মালয়েশিয়া টুডের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানান, ইন্দোনেশিয়ার কোনো নাগরিক আরসায় যোগ দিয়েছে কি না সে বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য না থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারি করছেন তাঁরা।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান, কুয়ালালামপুর থেকে এন. নানথা ও জাকার্তা থেকে তিয়া আসমারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *