বন্যায় মানুষ কষ্টে আছে – বাংলার দর্পন ডটকম

 

মন্তব্য প্রতিবেদনঃ

বাংলাদেশের মানুষ যখন প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বিপন্নপ্রায়, অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে, তখনো আমাদের নেতা-নেত্রীরা নির্বাচন নিয়ে বাগ্যুদ্ধে ব্যস্ত। তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে মনে হয়, নির্বাচন ছাড়া দেশে দ্বিতীয় কোনো সমস্যা নেই।

এ বছর কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ অনেক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে। প্রথমে হাওরে ফসল ডুবল। তারপর পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটল। তারপর অতিবৃষ্টিতে ঢাকা শহর আধাআধি এবং চট্টগ্রাম শহর পুরোপুরি ডুবে গেল। তারপর উজানের ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হলো। এসবের সঙ্গে নতুন উপদ্রব দেখা দিল চিকুনগুনিয়া নামে নতুন এক ব্যাধি।

অতিবৃষ্টির কারণে শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, সিলেট, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, জামালপুর, রাজশাহী, বগুড়াসহ অনেক শহরের জনজীবনই বিপর্যস্ত। ঢাকার মানুষ এত দিন যানজটে নাকাল ছিল, এখন জলজটে আক্রান্ত। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হলো সড়ক সংস্কারের নামে যথেচ্ছ কাটাকাটি। বর্ষার সময়ই কাজটি বেশি হয়। তাতে বরাদ্দ নয়ছয় করতে সুবিধা হয়। ঢাকা শহরে অনেক সেবা সংস্থা কাজ করে। কিন্তু একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সমন্বয় নেই। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায় কার? সিটি করপোরেশন বলছে ‘আমাদের নয়, ওয়াসার।’ ওয়াসার দাবি, খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি সরানো যাচ্ছে না।

পত্রিকায় দেখলাম, চট্টগ্রামের বহু সড়কে গাড়ির বদলে মানুষ নৌকায় চলাচল করছে। নৌকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক। বলা যায়, প্রতীকের সার্থক ব্যবহার। কিন্তু শুকনোর দিনে যখন পানি থাকবে না, তখন নৌকার কী হবে?

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় সবাই চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলে ভোট নেন। কিন্তু ভোটের পর ভুলে যান। আওয়ামী লীগের মেয়রের পর বিএনপির মেয়র। বিএনপির মেয়রের পর ফের আওয়ামী লীগের মেয়র নগরের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু জলাবদ্ধতা কমাতে পারেননি কেউ।

রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রী থাকেন, বিরোধী দলের নেতা থাকেন, মন্ত্রী ও মেয়ররা থাকেন, সাংসদেরা থাকেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই ঢাকা শহরকে আরেকটু বসবাস উপযোগী করার উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। কোনো সরকারের আমলে কোনো টেকসই ও সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে দেখা যায় না । দেড় কোটি মানুষের শহর কি এভাবে অরক্ষিত ও অপরিকল্পিত অবস্থায় থাকতে পারে?

ঢাকা শহরের বাসিন্দারা যে কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তা নিয়ে কখনো নীতিনির্ধারকেরা ভাবছেন বলে মনে হয় না। অপরিকল্পিত উড়ালসড়ক নির্মাণকে তাঁরা উন্নয়নের মডেল হিসেবে খাড়া করলেও এ কারণে যে লাখ লাখ মানুষ মাসের পর মাস যন্ত্রণা ভোগ করছে, সেসব নিয়ে মন্ত্রী কিংবা মেয়রদ্বয়কে সামান্য বিচলিত হতে দেখি না। নির্বাচনের আগে নগরবাসীকে ক্লিন ঢাকা, সবুজ ঢাকা ও আদর্শ ঢাকা গড়ার এবং নাগরিক সুবিধার বেশুমার খোয়াব দেখানো হয়েছিল, সোয়া দুই বছরে বলতে গেলে তার কিছুই পাওয়া যায়নি। বাকি পৌনে তিন বছরও এভাবে কেটে যাবে। এরপর যাঁরা আসবেন, তাঁরাও অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দেবেন, ইশতেহার ঘোষণা করবেন। কিন্তু নগরবাসীর দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে না।

বৃষ্টি ও বন্যার পাশাপাশি চালসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন আরও বেশি বিপর্যস্ত করেছে। যেখানে সরকারি গুদামে আপত্কালীন মজুত ছয় থেকে আট লাখ টন থাকার কথা, গত জুনে তা এসে দাঁড়ায় দেড় লাখ টনে। ফলে চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। তখনো খাদ্য মন্ত্রণালয় জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করতে থাকে যে সরকারি গুদামে প্রচুর চাল মজুত আছে, ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু যখন দেখা গেল কাবিখায় চালের বদলে গম দেওয়া হচ্ছে, তখনই গুমর ফাঁস হয়ে যায়। বিদেশ থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ কিংবা আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার প্রভাব তেমন পড়েনি বাজারে। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চালের দাম বৃদ্ধির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন। ভালো কথা। কিন্তু তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন। বলেছেন, আগামী তিন বছর তাঁদের কাছ থেকে কোনো চাল কেনা হবে না। খাদ্যমন্ত্রীর মতে, চালের বাজার কারসাজির সঙ্গে ১৬ হাজার অসাধু ব্যবসায়ী জড়িত। তাঁরা যদি দোষীই হন, সরকার কেন আইনি ব্যবস্থা নিল না?

প্রায় প্রতিদিনই বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খবর ছবিসহ পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো হয়। উপদ্রুত এলাকার অনেক মানুষ বিকল্প ব্যবস্থা না করতে পেরে জলমগ্ন বাড়িতেই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটছে। টিভিতে দেখলাম, কয়েকজন হতদরিদ্র মা কাঁদছেন। কান্না নিজের জন্য নয়, ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে পারছেন না বলে। সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল। তাও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছায় না।

দুর্গত মানুষের এই করুণ কাহিনিও রাজনীতিকদের স্পর্শ করে না। তাঁরা একে অপরের মুখ ম্লান করে দিতে ব্যস্ত। দুর্যোগ বা মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের মাথাব্যথা নেই। অথচ প্রায় প্রতিদিনই ২০১৮ সালের শেষে বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। নির্বাচনী বাগ্যুদ্ধে উভয় দল একে অপরকে ঘায়েল করলেও যাদের জন্য নির্বাচন, সেই জনগণের কথা ভাবছেন না। কদাচিৎ ব্যতিক্রম বাদে নেতাদের, জনপ্রতিনিধিদের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেও দেখা যায়নি। সরকারি দল কিংবা তাদের অনুগত বিরোধী দল হয়তো সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনের দোহাই দেবেন। কিন্তু সংসদেও দেখছি হাজিরার চেয়ে গরহাজিরা বেশি। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিভিশন ধন্যবাদ পেতে পারে, তারা ফাঁকা আসনগুলোও দেখাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদ নেত্রী উপস্থিত থাকলে তাঁর দলের সাংসদেরাও আসেন, কোনো কারণে তিনি অনুপস্থিত থাকলে অন্যরাও সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না।

আর ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনকারী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শয়নে-স্বপনে, আহারে-বিহারে এখন নির্বাচন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। তারা ভাবে একদিন নির্বাচনের কথা না বললে বোধ হয় প্রচারণায় পিছিয়ে পড়বে। অতীতে দেখেছি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে হলেও বিরোধী দল দুর্গত এলাকায় যায়। কিন্তু এবার বিএনপির নেতারা যাননি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনৈতিক বিষয়ে ‘পরামর্শ’ নিতে লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও বন্যাদুর্গত অঞ্চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি। সরকার তাঁকে জনসভা করতে দিচ্ছে না। কিন্তু দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বাধা দিলে তিনি বিষয়টি জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারতেন। আর সরকারি দলের নেতারা তো বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে জেলা ও বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করে দিয়েছেন। নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন।

অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অংশ নিয়েছিলেন, মাওলানা ভাসানী বর্জন করেছিলেন বা তাঁকে দিয়ে অতি বামেরা বর্জন করিয়েছিল—কিন্তু যখন ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় হলো, তখন দুজনেই ছুটে গিয়েছিলেন ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চলে। তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র-তরুণ এমনকি মেয়েরাও দল বেঁধে বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি একযোগে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। প্রায় বছরজুড়েই তাদের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু যখনই বন্যায় দেশ প্লাবিত হলো তখন তারা সব কর্মসূচি স্থগিত করে দুর্গত মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছাত্র, তরুণ ও গৃহবধূরাও রুটি বানিয়ে দুর্গত মানুষকে খাইয়েছিলেন।

কিন্তু এবার কোনো দলকেই আমরা বিপন্ন মানুষের কাছে পাচ্ছি না। রাজনীতি কেন এত গণবিচ্ছিন্ন হলো? কার আমলে পুকুর, খাল ভরাট হয়েছে, বাঁধ ভেঙে শস্য ভেসে গেছে, সেই বিতর্কে রাজনীতিকেরা মত্ত আছেন। প্রতিকারের উদ্যোগ নিচ্ছেন না।

রাজনীতির মাননীয় ও মহামাননীয়দের প্রতি আবেদন, নির্বাচন নিয়ে বাগ্যুদ্ধ অনেক করতে পারবেন। আপাতত বিপন্ন মানুষগুলোকে বাঁচান। তাদের মুখে খাবার তুলে দিন। মাথা গোঁজার মতো একটু জায়গার ব্যবস্থা করুন। সরকার প্রশাসনিকভাবে যা করার করবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী বা কর্মীদেরও কি কোনো দায়িত্ব নেই?

চিকুনগুনিয়ার দায় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ কমাতে জনসচেতনতা সৃষ্টির যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, এর উৎস মশা ধ্বংস করতে না পারলে মহামারি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ঢাকা শহরে প্রতি ১১ জনের মধ্যে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি নাকি উদ্বেগজনক নয়। আরও কতজন আক্রান্ত হলে তাঁরা উদ্বিগ্ন হবেন?

প্রথমে হাওরের বাঁধ ভেসে ফসলহানি, তারপর পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু, তারপর শহরে জলাবদ্ধতা, তারপর উজানের ঢলে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, কিন্তু কোনো দুর্যোগকেই রাজনীতিকেরা দুর্যোগ মনে করছেন না। রাজনীতি কেন এত বিবেকহীন হবে? কেন বিপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে না?

আমরা নেতাদের মুখে উন্নতির অনেক গল্প শুনছি। গণতন্ত্র, সুশাসনের অনেক স্বপ্ন তাঁরা দেখাচ্ছেন। মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো কোনো সূচকে আমরা ভারত থেকেও এগিয়ে আছি বলে নেতারা বেশ পুলকিত।

কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের সূচকে যে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি, সেটি একবারও কেউ চিন্তা করছেন না। দেশের মানুষ কষ্টে আছে, বন্যা, বৃষ্টি সেই কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতির কুশীলবেরা কী করছেন?

 

সোহরাব হোসেন -সাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *