নিজস্ব প্রতিবেদক |
ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে ভেদাভেদ নেই। মাত্র ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই পানির নিচে চলে গেছে ঢাকার দুই অংশের প্রধান প্রধান সড়ক, গলিপথসহ আশপাশের অনেক এলাকা। এটাই এখন বাস্তবতা। ফলে দুর্ভোগও যেন নিয়তি। এই দুর্ভোগ জলাবদ্ধতার, এই দুর্ভোগ অসহ্য যানজটেরও। সব মিলে মাঝারি বৃষ্টিতেই স্থবির এক রাজধানী।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেক বেলা ২টা পর্যন্ত কখনো থেমে থেমে, কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এতেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড, চকবাজার রোড (কারা অধিদপ্তরের সামনের অংশ), সিদ্দিকবাজার, নাজিরাবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়ক। জলমগ্ন হয়ে পড়ে মধ্য ঢাকার মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, রাজারবাগসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়ক ও গলিপথ। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা পরও দিলকুশা, আরামবাগ, ফকিরাপুল ও নয়াপল্টনের প্রধান সড়কে ছিল হাঁটুপানি। একই অবস্থা উত্তর ধানমন্ডি, কলাবাগান বশিরউদ্দীন রোড এবং জিগাতলার।
উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কারওয়ান বাজার এলাকা, এফডিসির সামনের সড়ক, গ্রিনরোডের কিছু অংশ, মিরপুর, কাওলা, খিলক্ষেতে জলজট পরিস্থিতি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে।
এর মধ্যে শান্তিনগর, মালিবাগ ও মগবাজার এলাকার ভাঙা সড়কে পথচলতি মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। খানাখন্দে ভরা সড়কে পানিতে ডোবা চোরা গর্তে পড়ে বেশ কয়েকটি রিকশা উল্টে যায়। পানি ঢুকে পড়ে মৌচাক মার্কেটের ভেতরের অংশে। সিদ্ধেশ্বরী, খিলগাঁও, গোড়ান, সিপাহীবাগ ও সবুজবাগ এলাকাও ছিল পানির নিচে।
মেয়র আনিসুল হক বললেন-
খাল ভরাট করে ভবন হয়েছে, পানি যাবে কোথায়? জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই মেয়র কী করছেন? ঢাকা ওয়াসাই বা কী করছে? এসব প্রশ্নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, এটা থেকে মুক্তির জন্য একধরনের বিপ্লব প্রয়োজন। ঢাকার খালগুলোর মধ্যে এখন দুইটাও বোধ হয় নেই। খাল ভরাট করে সেখানে চার-পাঁচতলা ভবন করা হয়েছে। পানি যাবে কোথায়? তবে মেয়রের দাবি, ‘এর জন্য সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই দায়ী না। খালের মালিক জেলা প্রশাসন, আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসার। তারা ২৫ বছরে এই খাল কী রক্ষণাবেক্ষণ করেছে, তার হিসাব দিক।’
দুপুর ১২টার পর হাটখোলা এলাকার কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ছিল দেড় ফুট পানি। বেলা আড়াইটায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এলাকায় সড়কের ওপর রাখা একটি ময়লার কনটেইনার দেখে মনে হলো পানিতে ভাসছে। প্রায় একই সময়ে আরামবাগ পেট্রলপাম্প ও পাশের টিঅ্যান্ডটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে হাঁটুপানি দেখা যায়। যদিও তখন বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছিল।
এ সময় শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত রোকেয়া সরণির দুই পাশ ছিল পানিতে থই থই। বেলা দুইটার পর যানজটে এই অংশটুকু পার হতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচলের সময় পানির ঢেউ কখনো কখনো ঢুকে যাচ্ছিল সড়কের পাশের দোকানগুলোতে। এ সময় সাইলেন্সার পাইপে পানি ঢুকে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি পিকআপ ভ্যানের চালক আবদুর রাজ্জাক খানিকটা পরিহাস করে বলেন, ‘বৃষ্টিতে এই শহরের জন্য সবচেয়ে ভালো যান হইল নৌকা। মোটরসাইকেল বন্ধ হইলে নৌকাত তুইল্যা নিয়্যা যাইবেন। বাসের জন্য দাঁড়ায়া না থাইকা মানুষ নৌকাত চইড়া বসবো। কোনো অসুবিধা নাই।’
এই অঞ্চলের কালশী, রূপনগর, বিশেষ করে চিড়িয়াখানা সড়কের অবস্থা ছিল সবচেয়ে সঙিন। বেলা সাড়ে তিনটায় জমে থাকা পানিতে চিড়িয়াখানা রোডে তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
এদিকে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গণপরিবহনগুলো আটকে ছিল। ফলে সব এলাকায় সময়মতো গাড়িও পাওয়া যায়নি। বেলা একটায় মতিঝিল যাওয়ার জন্য ফার্মগেটে গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন মোতালেব হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করেও গাড়িতে উঠতে পারেননি তিনি। বেশ ক্ষোভের সঙ্গে এই ব্যক্তি বলেন, ‘বৃষ্টি তো হবেই। তাই বলে এই সমস্যার কোনো সমাধান থাকবে না? একটা দেশের রাজধানীর যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সেই দেশ কত দূর আগাবে?’
বৃষ্টি শুরুর পর উত্তরা থেকে মহাখালীর রাস্তা প্রায় পুরোটাই যানজটের কবলে পড়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত স্থবির হয়ে ছিল। দুঃসহ যানজট ছিল মিরপুর রোডেও। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষ সবাইকে ভুগতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে গতকাল সকাল ছয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৪৩ মিলিমিটার। আবহাওয়ার পরিভাষায় এটি মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি। অধিদপ্তরের পূর্বাভাস, ১৪ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাতেরও সম্ভাবনা আছে। তাতে অবশ্যম্ভাবী জলজট ও যানজটে নগরবাসীর ভোগান্তি আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা।
জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসকিম এ খান বলেন, ‘ঢাকায় কোনো জলাবদ্ধতা নেই। …তবে জলজট আছে। এই জলজট নিরসনের জন্য আমাদের যে কৃত্রিম ব্যবস্থা, তা যথেষ্ট উন্নত। কিন্তু একবারে বেশি বৃষ্টি হলে নিষ্কাশনে সময় বেশি লাগে।’
নিষ্কাশন খালগুলোর কী হলো; সেগুলো তো আপনাদেরই রক্ষণাবেক্ষণের কথা?
ওয়াসার এমডি বললেন, খাল তো সবই আছে। ৬২টি খালের মধ্যে ২৬টি আছে। এর মধ্যে ১৩টি ডেভেলপ (উন্নয়ন) করা। বাকি ১৩টির উন্নয়ন চলছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক প্রথম আলো কে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ডিএনসিসি, ওয়াসা ও রাজউক মিলে একটি রোডম্যাপ (পথনকশা) তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সেটা হবে। আমরা দেখতে চাই, জলাবদ্ধতা থেকে কতটুকু মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে খালের ওপর থেকে সব ধরনের অবৈধ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে। আরও ড্রেন, খাল তৈরি করতে হবে।’
মেয়রের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাসকিম এ খান বললেন, ‘ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েই আছে। এই ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সাতটি সংস্থা জড়িত। এগুলো একটা সংস্থা অর্থাৎ সিটি করপোরেশনের আওতায় আসা উচিত। আর স্যুয়ারেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে আছে। সেটা আমরাই করছি।’
বৃষ্টিপাত আরও প্রলম্বিত হলে শহরের কী অবস্থা দাঁড়াবে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্থায়ী হলে ঢাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বসবাসরত নিম্ন-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হবে। জলাবদ্ধতার কারণে ঢাকা পানিদূষণের মুখে পড়বে। অসুখ-বিসুখের প্রকোপ বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ধাক্কা খাবে।
সমাধান জানতে চাইলে ইকবাল হাবিব বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের সঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভূমি প্রশাসন ও জেলা পরিষদ—এ পাঁচটি সংস্থা জড়িত। এগুলোর মধ্যে একটি সমন্বিত, সার্বিক, সময়নির্ভর কর্মপরিকল্পনা দরকার। তবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় যদি সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করা না যায়, এতে কোনো লাভ হবে না।