সড়কহীন সেতু বানানোর উন্নয়ন বিলাস

 

নারায়নগঞ্জ :

সেতুর কাজ হলো সংযুক্ত করা। একটি পাড়ের সঙ্গে অন্য পাড়ের, জনপদের সঙ্গে জনপদের যোগাযোগ ঘটানো। তবে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে ভেসে আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছি যে রাস্তা নেই, কিছুই যুক্ত করে না—এমন সব সেতুও আমরা নির্মাণ করে যাচ্ছি। ১০ মে-র  জানাচ্ছে, ‘নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভার ষোলপাড়া খালে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর সংযোগ সড়ক নেই। সেতুটি গ্রামবাসীর কোনো কাজে আসে না।’ তাহলে এ সেতু নির্মাণের হেতু কী? এর উপযোগিতাই বা কী? তারও উত্তর দিচ্ছেন এলাকাবাসী। তাঁরা জানান, সেতুর উত্তর পাশে জনৈক গাজী জুয়েল হোসেনের বাগানবাড়ি। একমাত্র তিনিই এ সেতুটি ব্যবহার করেন, তা-ও আবার শুধু বর্ষাকালে। তখন তিনি মই বেয়ে সেতুতে ওঠেন এবং পার হয়ে তাঁর নিজস্ব বাগানবাড়িতে যান। রাস্তা তো নেই, উপরন্তু সেতুটিতে উঠতে হলে মই ব্যবহার করতে হয়!

সরকারি অর্থায়নে একজন লোকের জন্য একটি সেতু নির্মাণ করতে পারার মতো ‘ধনী’ হয়ে গেছে আমাদের দেশ, এটি ভাবতে পারলে ভালো লাগত, সন্দেহ নেই। ওই একই দিনের প্রথম আলো পত্রিকা জানাচ্ছে, ৫০ বছর ধরে একটি সেতুর জন্য অপেক্ষা করে আছে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। ‘উন্নয়ন’ ওই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি এত বছরেও। সরকারের আশায় বসে না থেকে সেখানকার লোকেরা চাঁদা তুলে নিজেরাই নির্মাণ করেছেন বাঁশের সাঁকো। ওই সাঁকো থেকে প্রায় দিনই শিশু ও বয়স্ক মানুষ পড়ে গিয়ে আহত হয়। সাঁকোর পাশেই সাঁতারপুর বাজার, সেখানে প্রতিদিন বিকেলে হাট বসে, এ ছাড়া আরও নয়টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সাঁকোর দুপাশে। তবু ৫০ বছর অপেক্ষার পরও সেখানে তৈরি হয়নি কোনো কংক্রিটের সেতু। একজন লোকের জন্য যদি আস্ত একটি সেতু তৈরি করা সম্ভব হতে পারে, তবে লক্ষাধিক লোকের জন্য কেন সেটা পারা যায় না?

রাজশাহীর তানোর ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়েও সম্প্রতি এমনই কয়েকটি সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। গত ১২ এপ্রিলের যুগান্তর অনলাইন বলছে, রাজশাহীর তানোরে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সেতু তৈরি করতে ৩২ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৩ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ সেতুর দুপাশে কোনো রাস্তা নেই। অর্থাৎ ফাঁকা জমির ভেতর হঠাৎ যেন গজিয়ে উঠেছে এক আশ্চর্য সেতু। এলাকার মানুষ মাঠে যাতায়াত করে খেতের আইল দিয়ে। তবে কেন এই সেতু নির্মাণ করা হলো? সেতু বিশেষজ্ঞ নন, উত্তর পাওয়া গেল এলাকার অধিবাসী জালাল হোসেনের কথায়। তিনি বলেন, ‘সেতু নির্মাণের অজুহাতে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা সরকারি অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করছেন। এ প্রকল্প সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না।’

একটি-দুটি নয়, তানোরে এ রকম ছয়টি সেতুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলোর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এলাকার লোকজন বলেন, খাঁড়ির ওপর তৈরি হতে যাওয়া এসব সেতু আদতে জনগণের কোনো কাজেই লাগবে না। কেননা এগুলোর কোনোটার দুপাশেই রাস্তা নেই। সেতুর কাজ যোগাযোগ সহজ করা, এসব সেতু সহজ দুর্নীতির ফল। কোনো কোনো এলাকার মানুষ বছরের পর বছর একটি সেতুর জন্য হাহাকার করে আর কোথাও ফাঁকা মাঠে তৈরি হয় এ রকম সেতু। কী পরিহাস! বৈষম্য, অসম বণ্টনের কী দারুণ দুঃখজনক উদাহরণ!

শুধু সেতু নয়, প্রভাবশালী লোকজনের জন্য এমনকি স্টেডিয়ামের মধ্য দিয়েও তৈরি হয় রাস্তা, রীতিমতো পাকা সড়ক! ২০১৫ সালে চাঁদপুর শহরের আউটার স্টেডিয়ামের মাঝখানে মাঠ কেটে আরসিসি ঢালাই করে পাকা সড়ক তৈরি করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, স্টেডিয়ামের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির প্রধান ফটক। তখনকার সংসদীয় কমিটির সভাপতির একান্ত সচিব ও চাঁদপুর সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনুর শাহীন খানের নবনির্মিত বাড়িতে ঢোকার জন্য এ কাজটি করা হয়েছিল। আসলে যে জায়গাগুলোতে সেতু বা সংযোগ দরকার, সেখানে সেতু নেই।

ক্ষমতাবানের জন্য সেতু-সড়কে ব্যয় হয় জনগণের টাকা। অথচ সেতু নেই ধনী ও গরিবে। ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ধনী আর গরিবের ব্যবধান এত বিশাল, এত অসম যে সেখানে কোনো ধরনের সেতুবন্ধই গড়ে ওঠা কঠিন। গত ১৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষের মোট যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তার সমপরিমাণ সম্পদ আছে শীর্ষ আটজন ধনীর হাতে। অর্থাৎ বিশ্বের আটজন লোকের সম্পদ সমান ৩৬০ কোটি মানুষের মিলিত সম্পদ। এ বৈষম্যে কি কোনো সম্পর্কের সেতু নির্মিত হওয়া সম্ভব? অক্সফাম আরও বলছে, পৃথিবীর ১০ জনের মধ্যে ১ জন লোক মাত্র ২ ডলারে দিন চালায়। ভয়াবহ এই অসাম্য মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে ক্রমাগত। ফলে দুনিয়ার এখানে-সেখানে অস্থিরতা, সংঘাত সর্বদাই চলমান থাকে।

শুধু এ সরকারের আমলে নয়, অহেতুক সেতু ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে নানা সময়ে। বিএনপি আমলে ২০০২ সালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় এ ধরনের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। রাস্তা নেই এমন জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল চারটি কালভার্ট। অদরকারি রাস্তাসহ কয়েকটি সেতু নির্মাণে তখনকার সময়ে ‘লিচুতলা-কদমতলী এবং নাংলু-বালিয়াদিঘি সংযোগ সড়কসহ ধুনট-নাংলু-বাগবাড়ি-কদমতলী-গাবতলী-চৌকিরহাট সড়ক নির্মাণ প্রকল্প’ নামে এর প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭০ কোটি টাকা।

খোঁজ নিলে নারায়ণগঞ্জ বা রাজশাহী বা বগুড়ার সেতুগুলোর মতো আরও অনেক সেতুই মিলবে, যেগুলো ফাঁকা মাঠের ভেতর অসহায়ের মতো হাস্যকরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজ লোকদের পকেট ভারী করতেই যে এসব স্থাপনা, তা বলাই বাহুল্য। যেখানে সত্যিকার অর্থেই মানুষের মৌলিক প্রয়োজন উপেক্ষিত, সেখানে এমন ‘উন্নয়নবিলাস’ আশ্চর্য বললেও কম বলা হয়। বহুতল অট্টালিকার সারির পাশে যখন বস্তির হাড়-জিরজিরে লোকগুলো দৃশ্যমান হয়, তখন উন্নয়নের চেয়ে, পারস্পরিক সেতুবন্ধনের চেয়ে, বৈষম্যই অধিক প্রকট হয়ে ওঠে। কবি আল মাহমুদ তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন’। তবে ‘সুষম বণ্টনের’ খুব বেশি নজির আর আজকের পৃথিবীতে নেই। যাবতীয় ‘বণ্টন’ শুধু প্রভাব ও বিত্তশালীদের প্রতিই হতে দেখা যায়।

অসম সম্পর্কের সেতুর মতো ফাঁকা মাঠে দাঁড়ানো যুক্ততাহীন হাস্যকর সেতু নয়, আমরা চাই এমন সেতু, যা ধনী-গরিবে সাম্যের বন্ধন গড়বে, জোড়া দেবে দুই পারের জনপদ ও মানুষগুলোকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *