খন্দকার রাকিব ॥ প্রকাশ- ৩০ নভেম্বর১৬।।
বরিশাল বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় গত কয়েকদিন ধরে কেন্দ্রিয় কর্মসূচিতে রাজপথে সোচ্চার থাকলেও সংগঠনের অভ্যন্তরিণ অবস্থা ভাল নয়। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মিরা দায়িত্বশীল নেতাদের ওপর আস্থাহীনতায় কারও ডাকে সায় দিচ্ছেন না। ফলে দলীয় কর্মসূচিতে কর্মি-সমর্থকদের অংশগ্রহণে তোড়জোড় নেই। নেতৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে বিভাজনে সৃষ্টি হয়েছে নাজুক পরিস্থিতি। দলের স্থানীয় কাণ্ডারি সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রিয় পদ পাওয়ায় মহানগরের নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়া নিয়ে দোদুল্যমান থাকায় অনেকে বিষয়টি ভাল চোখে দেখছেন না। কিন্তু কেন্দ্রীয় এই নেতা বলছেন তিনি মহানগরের পদ ছেড়ে দিয়ে সহ সভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুককে তার স্থলে দায়ীত্ব দিয়েছেন । বিপরিতে ফারুক সরোয়ারের এই দাবী অস্বীকার করায় দলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না আসলে কার কথা সত্য? সরোয়ার যদি নেতৃত্ব ছেড়ে দেয় তাহলে সে ক্ষেত্রে দল পুনর্গঠনে এই নেতার একক সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পাওয়ার আশংকায় নেতৃত্ব প্রত্যাশিরা ক্ষুব্ধ বলে জানাগেছে। তাছাড়া তারই সহোদর ওয়াহিদুজ্জামান ওয়াহিদকে সাধারণ সম্পাদক করা হচ্ছে এমন খবরে ঘনিষ্টজনেরাই সরোয়ার’র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। এমনকি সরোয়ার’র ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলর জিয়াউদ্দিন সিকদার একই পদের দাবিদার হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক জটিল সমীকরণ। একদিকে দলীয় বিভেদ, অন্যদিকে পদ ছাড়া নিয়ে নানান হিসেব নিকেশে স্বস্তিতে নেই সদ্য মনোনিত কেন্দ্রিয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার। দল ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র এমন তথ্য দিয়ে বলছে, বরিশাল বিএনপি’র সেই অতিত জৌলুস ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। সূত্রের অভিমত, সাংগঠনিক এই নাজুক পরিস্থিতির জন্য দলের একটি বৃহৎ অংশ সরোয়ারকেই দায়ি করছে। বর্তমান সরকার আমলের শুরুতেই তীব্র আন্দোলনে বরিশালে গড়ে তুলতে ব্যার্থ হওয়ায় কেন্দ্রিয়ভাবেও এই নেতা অনেকটা কোণঠাসা ছিলেন। আন্দোলন সময়কাল ও পরবর্তিতে পুলিশি হয়রানি এবং কারাবন্দি থাকা অবস্থায় নেতাকর্মিদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দলীয় সহায়তা না পাওয়ায় সংগঠনের মধ্যে সুচিত হয় ােভের প্রথম পর্ব। তাছাড়া একই নেতা একাধিক অঙ্গসংগঠনের পদ আগলে থাকায় নেতৃত্ব বঞ্চিতরা এর জন্য সরোয়ারকেই দায়ী করেন। অবশ্য কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না সরোয়ার’র বিকল্প কোন নেতা সৃষ্টি না হওয়ায়। দলের মধ্যে একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ তুলে অনেক দায়িত্বশীল নেতাও ক্রমশ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। জেল জুলুমের শিকার মাঠের কর্মিরাও সরোয়ারের ডাকে সাড়া না দেয়ায় কোন আন্দোলন কর্মসূচিও জমে উঠছে না। এমতাবস্থায় মতাসীন আ’লীগ মাঠ দখল করায় বিএনপিকে রাজপথে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন দলীয় শুভাকাক্সীরা। তবে সরোয়ার ‘কারিশমাটিক’ নেতা হলেও পূর্বের সেই ছায়া তার মাঝে ¤ান। দলীয় কর্মি-সমর্থকরাই মনে করছেন। দাপটশীল এই নেতা এখন অনেকটাই আহত বাঘ সাদৃশ্য। দলীয় মূল নেতার এই করুণ হালের জন্য সংগঠনের মধ্যে আরেকটি কারণ উচ্চারিত হতে শোনা যায়। এক সময় বিভাজন বিএনপি’র অপরাংশের নেতা আহসান হাবিব কামাল সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার সাথে সরোয়ার’র ঐক্য সৃষ্টি হওয়ায় তার অনুসারি অনেক দায়িত্বশীল নেতা পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করছেন স্বার্থগত কারণেই তাদের মধ্যকার এ ঐক্য। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, কেন্দ্রিয় যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পর মহানগরের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া নিয়ে সরোয়ারের বর্তমান ভূমিকায় দলীয় কোন্দল আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক নেতাই অপোয় রয়েছেন কেন্দ্রিয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সরোয়ার মহানগরের সভাপতি পদ ছেড়ে দিলে দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের একটি স্থানে দেখতে চান। কিন্তু আদৌ তিনি পদ ছেড়েছেন কী না তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও তিনি মিডিয়ার কাছে জোর দিয়ে মতপ্রকাশ করেছেন গতমাসে মহানগরের পদ থেকে ইস্তেফা দিচ্ছেন। তার এই মন্তব্যের পর কথা উঠেছে নতুন করে মহানগরের কমিটি গঠন হলে আহসান হাবিব কামালকে সভাপতি এবং সহদর শ্রমিকদল নেতা ওয়াহেদকে সাধারণ সম্পাদক করে সরোয়ার মহানগরের নেতৃত্ব নিজের কবজায় রাখতে চান। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আহসান হাবিব কামাল কেন্দ্রিয় পদ ছেড়ে দেয়ায় মহানগরের কমিটিতে আসা অবশ্যম্ভবী হওয়ায় তাকে নিয়ে উড়ো খবরটি জোরালো রূপ পেয়েছে। কিন্তু সভাপতি হিসেবে মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়াউদ্দিন সিকদার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন কমিটিতে আসতে উন্মুখ। সরোয়ার ঘনিষ্ট এই দুই নেতার মধ্যে প্রথমজন বর্তমান কমিটির সহ সভাপতি ও দ্বিতীয় জন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। গত বছর মহানগরের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. কামরুল আহসান শাহীন’র আকস্মিক মৃত্যু পরবর্তি সরোয়ার তার বিশ্বস্থ অনুসারি হিসেবে জিয়াউদ্দিন সিকদারকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেন। সেই জিয়াউদ্দিন সিকদার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন কমিটিতে স্থান নিশ্চিত করতে কোন ছাড় দিতে অনঢ় অবস্থানে রয়েছেন বলে জানাগেছে। অথচ সরোয়ার তার ভাইকে এই পদে নিয়ে আসতে নিরব প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় এই নেতা বেশ কিছুদিন আগে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মহানগরের পদ ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে কমিটি পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত তার স্থলে মনিরুজ্জামান ফারুককে দায়িত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন। কারও কারও ধারনা তার এই ঘোষণার নেপথ্যে একটি সুদুরপ্রসারিত পরিকল্পনা রয়েছে। পুনর্গঠিত দলে ফারুককে পুনর্বহাল করার আগাম প্রস্তুতি মুলক এই ঘোষোনার হেতু। কিন্তু মনিরুজ্জামান ফারুক দাবী করেছেন তাকে এখনও দায়ীত্ব দেয়া হয়নি। সরোয়ারের পদত্যাগের বিষয়টি তার অজানা(?) সংগত কারনে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক হিসেব নিকেশে সরোয়ার মহানগরের পদ ছাড়তে চাচ্ছেন না। দলীয় সূত্র জানায়, কেন্দ্রিয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক নেতা দ্বৈত পদে থাকতে পারবেন না বিধায় সরোয়ারকে শিঘ্রই মহানগরের পদ ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেকায়দায় পড়া সরোয়ার এখন হাইকমান্ডকে রাজি-খুশি করতে পদ ছাড়তে সম্মতি জানিয়ে মহানগরের নয়া কমিটি কিভাবে গঠন করা যায় তার একটি খসড়া একাকি তৈরি করেছেন বলে সংগঠনের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। সম্ভাব্য সেই কমিটিতে সরোয়ারের ঘনিষ্টজনেরা স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনায় এই নেতার উপর অভিমানে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করেছেন। তারা এখন অনুসারিদের নিয়ে নিজ নিজ দপ্তরে সময় দেয়ায় সরোয়ার কার্যালয়ে আসলেও তারা থাকছেন অনুপস্থিত। আবার আসলেও তা হচ্ছে দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি প্রকাশ মাত্র। সাংগঠনিক এ পরিস্থিতিতে সরোয়ার পড়েছেন বেকায়দায়। দীর্ঘ রাজনীতিতে পোড় খাওয়া এই নেতা সম্ভবত এবারই কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন বলে তার অনুসারিরাই স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি এ তথ্য মানতে নারাজ। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, বাহির থেকে অনেক কিছুই শোনা যায়। বাস্তবে এ তথ্যের কোন ভিত্তি নেই। সবই গুজব মাত্র। তার দাবি দল বিরোধী পজিশনে থাকলে সঙ্গত কারণেই নানা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়, আর আপনা আপনি ব্যর্থতার দায়ভার চাপে মূল নেতার ওপর। তিনি স্পষ্ট করেছেন কেন্দ্রিয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহানগরের পদ ছাড়েছেন। তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার এই দাবির সত্যতা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। আবার তা সহদর ওয়াহিদের নতুন কমিটিতে গুরুত্বপুর্ন পদে আসার খবরটি গুজব বরে তিনি উড়িয়ে দেন। কমিটি কিভাবে গঠন হবে এবং কে আসবেন নেতৃত্বে? এমন প্রশ্নে সবার সম্মতিক্রমেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি জানান।