ফেনী প্রতিনিধি :
সেই ঔপনিবেশিক আমলের বৃটিশ স্থাপত্যকলায় নির্মিত ইট, চুন, সুড়কি আর কড়ি বড়গার দ্বিতল লাল-সাদা দালানটি সোজাসুজি লম্বা এক দুর্গ মনে হলেও এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০০৭ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর ভবনটিতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকে তালা বন্ধ পরিত্যক্ত ভবনটি। এখন ভেতরে ইঁদুর আর চামচিকের বাস। ভ্যাপসা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, স্থানে স্থানে ফাটল, বেরিয়ে পড়ছে, তার স্থলে আগাছা জন্মে ক্ষয়ে ক্ষয়ে, আস্তর খসে কঙ্কাল বেরিয়ে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোনমতে টিকে আছে এখন জরাজীর্ন বয়সের ভারে ন্যুজ ঐতিহাসিক এ ভবনটি। সংস্কার আর সংরক্ষনের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ১৩০ বছরের কালের সাক্ষী এ স্থাপনাটি।
১৮৮৬ সালে তৈরী করা এ দালানটি ১৩০ বছরের অধিককাল এ জনপদের শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু ‘বাতিঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তৎকালীন ফেনী মহকুমা প্রশাসক কবি নবীনচন্দ্র সেন এ বর্ধিষ্ণু জনপদে জ্ঞানের আলো ছড়াতে চেয়েছিলেন, তার সে প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে ‘ফেনী হাই স্কুল’ নামে যে বাতিঘর স্থাপন তিনি করেছিলেন সেটি আজও এ জনপদে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এমনও পরিবার আছে যাদের ৫ম প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে এ স্কুলেই লেখাপড়া করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মও এ বিদ্যালয়ে এসে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে দুর দুরান্তে বেরিয়ে পড়বেন। সেই বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত ফেনী জেলার পাঠদানের কেন্দ্রবিন্দু এ বিদ্যালয়টি। পাকিস্তান আমলে উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্কুলকে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রকল্প ‘পাইলট’ প্রজেক্টের আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ‘ফেনী হাই স্কুল’ ও ছিল।
পৃথক দুটি আলাদা ভবনে গাদাগাদি করে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চললেও লাল রঙের দ্বিতল মূল ভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। আগে এটিই ছিল প্রশাসনিক ভবন। শুধু শিক্ষা কার্যক্রমই নয় ফেনী পাইলট স্কুলের এ ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৩০ বছরের এ অঞ্চলের ইতিহাস। বৃটিশ শাসন, পাকিস্তান আমল, এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ইতিহাসও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময় স্কুলটি ব্রিটিশ আর্মি ক্যা¤প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি বিমান বোমা হামলা চালানোর সময় একটি বোমা স্কুলের উত্তর পাশের লাল রঙের মূল ভবনটির পাশে পড়লে ভবনটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনসময়েও পাকিস্তানি আর্মি এটিকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথিপত্র ধ্বংস হয় সেসময়। পাক আর্মি ওইসময় একটি ‘টর্চার সেলে’ পরিণত করেছিলো ভবনটিকে। স্কুলটির আশেপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি অচিহ্নিত গণকবর। এছাড়া দক্ষিণ পাশে ছাত্রাবাসের পাশে জলাপূর্ণ স্থানটিতেও গণকবর রয়েছে। ১৯৭১ এ নিহত শহীদদের স্মরণে স্মরণে স্কুলের পূর্ব প্রান্তে একটি স্মৃতি স্তম্ভও রয়েছে। ১৩০ বছরের ঐতিহাসিক এ প্রতিষ্ঠানটি জন্ম দিয়েছে জাতির অনেক সূর্য সন্তান।
অথচ ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের ব্যাপারে কারোই কোন উদ্যোগ নেই এ পর্যন্ত। এভাবে চোখের সামনে অবহেলায় আর অযত্মে হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী এ ভবনটি? কালের আর্বতে বিলীন হয়ে যাবে ‘বাতিঘর’টি। এ ব্যাপারে কেউ কোন আশার কথা শোনাতে পারলনা মোটেও। তবে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন, নবীন-প্রবীন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই একমত ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের ব্যাপারে।
অনেকেই মতামত দিয়েছেন এটিকে সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরের। অচিরেই আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে ভবনটিতে সংস্কার ও সংরক্ষণ করা জরুরী প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। তবে সেজন্য সমিন্বত উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরী। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকার, গণপুর্ত অধিদপ্তর, প্রত্মতাত্তিক অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। তবে চোখ থাকতে অন্ধ হয়ে থাকার চেয়ে দালানটি রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আমাদের সকলের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
সম্পদনা/এমএ