সৈয়দ মনির আহমদ:
সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকান্ড নিয়ে প্রবাসি ইউটিউবার ইলিয়াছ হোসেনের ডকুমেন্টারি একটি ভিডিও প্রকাশের পর সোনাগাজীতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নুসরাতের ঘটনাটি পুণঃতদন্তের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অনেকে। গত তিন অক্টোবর রাত ৮টায় নিজের ইউটিউব ও ফেসবুক পেজে ৩৬মিনিট ৪৭সেকেন্ডের ওই ভিডিও প্রকাশ করেন অ্যামেরিকা প্রবাসি ইউটিউবার ইলিয়াছ হোসেন। ভিডিওতে নুসরাত হত্যাকান্ডকে আত্মহত্যা প্রমাণ করতে মাদরাসার বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাহকে সৎ, দন্ডপ্রাপ্ত গভর্নিং বডির সদস্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ধর্মপ্রিয় এবং ভিকটিম নুসরাত জাহানকে দুঃশ্চরিত্রা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া ওই ভিডিওতে আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যাকান্ড বানানোর চেষ্টার জন্য মুল দোষারোপ করা হয়েছে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনোজ কুমারকে।
ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকটি মোবাইল ম্যাসেজ দেখিয়ে নুসরাতকে বহুমাত্রিক প্রেমিকা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মাদরাসার বহিষ্কৃত ও দন্ডপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাহর ব্যপারে বলা হয়েছে সে সৎ মানুষ গড়ার কারিগর তার বিরুদ্ধে কোন নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা নেই। মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ সভাপতি ও উপজেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি দন্ডপ্রাপ্ত রুহুল আমিন ও কমিটির সদস্য কাউন্সিলর মকসুদ আলমকে নির্দোষ বলা হয়েছে। ভিডিওতে দন্ডপ্রাপ্ত মাদরাসাছাত্র শামীম, জোবায়ের হোসেন, মহিউদ্দিন, মাদরাসা শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদেরসহ কয়েকজন আসামীর তৎকালীন মোবাইলের অবস্থান দেখিয়ে তাদেরকেও নির্দোষ বলা হয়েছে। এছাড়া ভিডিওতে দন্ডীতদের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে আসামীদের কাছ থেকে পিবিআইয়ের টাকা আদায়ের ঘটনা দেখানো হয়েছে। ভিডিওতে টাকার বিনিময়ে রায় দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে ওই মামলার বিচারকের বিরুদ্ধে।
গত তিন অক্টোবর রাত ৮টায় এই ভিডিও প্রকাশের পর থেকে উপজেলায় সর্বমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। চর দরবেশ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ হাসান বলেন, সত্য কখনো চাপা থাকেনা। দীর্ঘদিন পরে হলেও সত্য প্রকাশ হয়েছে। নির্দোষ নেতাদের মুক্তি চাই এবং নুসরাতের ঘটনাটি পুণঃতদন্তের দাবি জানাই। উপজেলা যুবলীগের সহ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বলেন, এই ভিডিওতে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি প্রমানিত হয়েছে । আমরা বলেছিলাম এটি হত্যা নয় আত্মহত্যা ।
মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি হোসেন টিপু বলেন, রাজাকারপুত্র ইলিয়াছ হোসেন প্রধানমন্ত্রী ও আ’লীগ সরকার বিরোধি একজন ইউটিউবার তার ভিডিও কোনভাবে বিশ্বাস করা ঠিক হবেনা। উপজেলা যুবলীগের সাধারন সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, নির্দোষ আ’লীগ সভাপতি রুহুল আমিন সহ সকলের মুক্তি চাই।
সোনাগাজী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহজাহান সাজু বলেন ভাইরাল এই ভিডিওতে প্রমান হয়েছে নুসরাতকে কেউ হত্যা করেনি। এটি হত্যা নয় আত্মহত্যা।
উপজেলা আ’লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক আকবর হোসেন বলেন, ইলিয়াছ হোসেনের সবকটি ভিডিও সরকার ও সরকারি সংস্থাকে বিতর্কিত করার জন্য প্রচার হয়েছে। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এভাবে উপজেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি দন্ডপ্রাপ্ত রুহুল আমিনের অনুসারী শতাধিক আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এই ভিডিওটি ডাউনলোড করে নিজ নিজ ফেসবুকে প্রচার করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
ভিডিও প্রকাশের তিন দিন আগে ২৯ সেপ্টেম্বর সোনাগাজী থানায় জিডি করেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। জিডিতে নোমান উল্লেখ করেন দন্ডপ্রাপ্তদের সহযোগীতায় প্রবাসি ইউটিউবার ইলিয়াছ হোসেন ও সমকালের সোনাগাজী প্রতিনিধি আবুল হোসেন রিপন ভিডিও বানানোর নামে ভিকটিম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র করছে। তিনি দ্রুত এর প্রতিকার চান । তবে ভিডিও প্রকাশের পর তিনি কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি।
অপরদিকে পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ও রাশেদুল হাসান রায়হানের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন সমকাল’র উপজেলা প্রতিনিধি আবুল হোসেন। তিনি জিডিতে উল্লেখ করেন পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায় নোমান ও রায়হান তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে।
ফেনী জজকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি মাহফুজুল বলেন, একটি আত্মহত্যাকে সুকৌশলে হত্যায় রুপ দেয়ায় পিবিআইয়ের প্রধান বনোজ কুমারের শাস্তি হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্মিলনের চেয়ারম্যান ফেনী জজকোর্টের আইনজীবি জাহাঙ্গীর আলম নান্টু বলেন, সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ঘটনাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন টাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১৬আসামীর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছে বিচারক মামুনুর রশিদ। আসামী পক্ষ যদি ন্যায় বিচার চায় তারা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। উচ্চ আদালত অবশ্যই ন্যায় বিচার করবেন। ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে কোন ফল পাওয়া যাবেনা। ইলিয়াছ হোসেনের ব্যপারে তিনি বলেন, ইলিয়াছ চিহ্নিত সরকার ও আ’লীগ বিরোধি একজন ব্লগার। এই ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে সে সরকার , আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিতর্কিত করা চেষ্টা করেছে। যা বাদি-বিবাদি কোন পক্ষের জন্য মঙ্গল হবেনা।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হন নুসরাত জাহান রাফি। ওই ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। এর জেরে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ৯এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে সে মারা যায়। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয়।
২৪ অক্টোবর ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যু দণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপার বুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চে এ মামলা শুনানির জন্য রয়েছে।
সম্পাদনায়: সৈয়দ মনির আহমদ, বাংলারদর্পণ