গোলাপের মতো ছড়িয়ে পড়ুক তাঁর আদর্শ | বাংলারদর্পণ

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ :
খুব হাসতেন তিনি, হা হা হা করে, অট্টহাসি। মনে হতো এমন হাসি ছাড়া তাঁকে মানাবেই না। তাঁর হাসি দেখে আমার মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা সৃষ্টি হতো, যে হাসিতে অভিনয় থাকতো না, থাকতো না কোন ছলচাতুরী। বুড়ো বয়সেও তিনি কর্মদক্ষ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত অফিসে গেলে তিনি বসিয়ে রাখতেন দীর্ঘক্ষণ। নানা গল্প করতেন, দুষ্টামি করতেন আর হাসতেন।

আমি তার নাতির সমান অথচ তিনি আমাকে আপনি করে সম্বোধন করতেন, আমাকে দেখলে তিনি প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরতেন, রাজনৈতিক জীবনের নানা সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করতেন। ফেনীর সাংবাদিকদের মাঝে অনৈক্য থাকায় নিয়ে তিনি খুব আক্ষেপ করে বলতেন, সাংবাদিকদের মাঝে এত গ্রুপিং আগে কখনোই দেখিনি। এবং বলতেন, এখন সাংবাদিকতায় অযোগ্যরা বেশি। জানাশোনা, পড়াশোনা করা সাংবাদিকদের খুব অভাব। কিন্তু একটা সময় শিক্ষিত ও জানাশোনা মানুষরা সাংবাদিকতা করতেন।

আজিজ আহমেদ চৌধুরী সত্যিকারার্থে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। হুট করেই তিনি নেতা হননি। যিনি ইউপি সদস্য থেকে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন, দীর্ঘ ২৫ বছর আনন্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন, হয়েছেন ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ফেনী জেলা শাখার সভাপতি, পর্যায়ক্রমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন।

দীর্ঘ এ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ফেনীর আনাচে কানাচে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে তাঁর পরিচয় গড়ে উঠেছে। সবার কথা তিনি শুনতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান পতন মোকাবেলা করে তিনি জনপ্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠদের একজন। যিনি কোন কিছুর বিণিময়ে রাষ্ট্রের মতাদর্শের বাইরে কাজ করেননি। ফেনী রাজনীতিতে প্রয়াত খাজা আহমেদ, এবিএম তালেব আলী, খোকা মিয়ার কাতারে চলে গেছেন আজিজ আহম্মেদ চৌধুরী। জাতীয় চার নেতা এবং মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার বিশাল আনুগত্য ছিল।

আজিজ আহমেদ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি মনে প্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ ছিলেন। একজন রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দল মত নির্বিশেষে যিনি ছিলেন সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য ও আদর্শের। তিনি যেমন মসজিদে গিয়ে কোরআন ও হাদিসের বাণী শুনিয়ে মানুষকে সৎ পথের উপদেশ দিতেন তেমনি মন্দিরে গিয়েও তিনি শ্রীমতবগবতগীতার কাহিনী শোনাতেন। যেমন শুনতেন এলিট শ্রেণির কথা শুনতেন জেলেদেরও কথা। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর বেশ সখ্যতা ছিলো।

গত বছর ঈদের ছুটিতে তাঁর বাসায় দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা আপনি তো বিভিন্ন বক্তৃতায় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেন, আচ্ছা অসাম্প্রদায়িকতা মানে কী, বাঙালি কী আসলে অসাম্প্রদায়িক?

তিনি গম্ভীর হয়ে বলা শুরু করেন, অসাম্প্রদায়িকতা বাঙালির রক্তে, শত বছর ধরে এ বাংলায় হিন্দু মুসলামান ও বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষে একসাথে বসবাস করেছে, ভিন্ন মতাদর্শের জন্য কাউকে হেয় করা হয়নি, পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ ছিলো, একে অপরের আচার-অনুষ্ঠানে গিয়েছে, ছিলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা, ছিলো না ধর্মীয় কোন বৈষম্য। একটা রাষ্ট্রে নানা ধর্মের নানা মতের মানুষ থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্র কারো পক্ষ নিবেনা, রাষ্ট্র তাকে নাগরিক হিসেবে মুল্যায়ণ করবে।

উদাহারন দিয়ে বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমাদের নবীজি। তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে কোন মানুষকে বিচার করতেন না। তিনি ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর জন্য রহমতস্বরুপ। বুঝতে হবে- অসাম্প্রদায়িকতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এটা ধর্মের বিশালকতা ও উদারতা।

বিদায় হজ্বের ভাষণ শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের কথা বলেছিলেন মহানবী। যেমন বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজি বলেছিলেন, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। মহানবী রাজনীতিবিদের জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ।

তিনি একবার সোনাগাজী দাসের হোট উচ্চ বিদ্যালয়ে মনিকা দাস নামে এক সনাতন ধর্মের মেয়ের প্রার্থনা সঙ্গীত শুনে মেয়েটির খুব প্রশংসা করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আচ্ছা, মেয়েটি গীতা পড়ল আর আপনি এত প্রশংসা করলেন। আপনি তো মুসলমান, গীতা পড়ার প্রশংসা যে করলেন তাতে আপনার গুনাহ হবে না? তিনি হাসি দিয়ে বললেন-সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের জন্য। কোন ধর্মই মানুষের ক্ষতির কথা বলেনি। বাহ কী অসাধারণ উত্তর।

তিনি যেমন বিভিন্ন পূজা পার্বনে মন্দিরগুলোতে যেতেন এবং ওয়াজ মাহফিলেও যেতেন। ছিলেন সহজ সরল ও ধার্মিক আর খাটি একজন দেশপ্রেমিক। বাঙালির জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন।

অবহেলিত, শোষিত নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ছিলেন। তাঁর আরেক নাম গোলাপ চৌধুরী। কে এ নামকরণ করেছিলেন জানি না। মনে হয়েছে এ নামটি যথার্থই। যিনি গোলাপের মতো ফেনীর রাজনীতিতে সুভাস ছড়িয়েছেন রাজনীতিতে, শিক্ষা-দীক্ষায় ও সমাজ উন্নয়নে।

মৃত্যু অনিবার্য একটি বিষয়, মৃত্যুই জীবনের সৌন্দর্য, মৃত্যুই সত্য। এ সত্য ও সৌন্দর্যের দিকেই ধাবিত হলেন তিনি। ফেনীবাসী হারিয়ে ফেলল একটি গোলাপ। গোলাপ হারালেও তার সুভাস এখানকার রাজনীতিতে প্রজন্ম থেকে প্রজেন্মে ছড়াবে।

লেখক,শাহাদাত হোসেন তৌহিদ
নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক শেয়ার বিজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *