নিজস্ব প্রতিবেদক :
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায়ের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। রাজনৈতিক ক্যাডারদের সাথে মিলে মিশে তিনি নিজেই প্রফেশনাল ষ্টান্ডার্ড ভঙ্গ করে অপরাধ করে যাচ্ছেন। বিতর্কিত ফেনীর সাবেক পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের দোষর বলেও তাকে অনেকেই জানেন।
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের গ্রেপ্তারের পর এবার ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায়ের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগিরা। নানা অনিয়ম, র্দুনীতি আর ঘুষ কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে সুদ্বীপ রায় ছাড়িয়ে গেছেন ওসি মোয়াজ্জেন হোসেনকেও। প্রতিদিন তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের কাছে নতুন নতুন অভিযোগ আসছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখা গেছে, ঘুষ দুর্নীতিতে ডুবে গেছেন সুদ্বীপ রায়। চোরা কারবারীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বাণিজ্য, বিনাকারনে থানায় ধরে এনে টাকা আদায়, ঘুষ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেয়া, বিয়ের কাবিনের টাকা মেরে দেয়া, বিকাশ ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, সালিশ বানিজ্য, থানার দালালদের সাথে সখ্যতা, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায়, বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁদা আদায় সহ বহু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। থানায় ধরে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ছাগলনাইয়া বাজারের ব্যবসায়ী হামিদ লাইব্রেরির মালিক আব্দুল হামিদ জানান, গত ২২ জুলাই তার ছোট ভাই আবদুল করিম ঠিকাদার খাগড়াছড়ি থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। বিকালে ফেনী ট্রাংক রোড়ে পৌঁছার পর ছাগলনাইয়া থানার এএসআই আলী তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। খবর পেয়ে আবদুল হামিদ থানায় ছুটে যান। এএসআই আলী তাকে জানান, তার ভাইয়ের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে। হামিদ বলেন, ‘ আমার ভাই জীবনে কোন দিন একটা সিগারেটও খায়নি। পুলিশের কথা শুনে আমার মাথার উপর যেন আসমান ভেঙে পড়ল। আমাকে ছোট ভাই বলেছেন , এগুলো পুলিশের সাজানো।
সব মিথ্যা। হামিদ বলেন,‘ ছোট ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে ওসি তদন্ত সুদ্বীপ রায়ের সঙ্গে কথা বললে, তিনি আমার কাছে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। অন্যথায় রাতে ক্রসফায়ার দেয়ার হুমকি দেন’। ‘আমি অনুনয় বিনয় করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ওসি তদন্তের হাতে তুলে দেই। কিন্তু টাকা নিয়েও ওসি (তদন্ত) আমার ভাইকে ১১০ পিস ইয়াবা দিয়ে কোর্টে চালান করে দেন। তারা যদি চালান করবে, তাহলে আমার কাছ থেকে টাকা কেন নিয়েছে। আমি পুলিশ সদর দফতরে এ বিষয়ে নালিশ করব।’ তবে এ এস আই আলী বলেছেন, আবদুল করিমকে মাদকসহ আটক করা হয়েছে। টাকা নেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে, তিনি এড়িয়ে যান। ছাগলনাইয়া শহরের নিউ মার্কেটের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কামাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ৪ এপ্রিল ২০১৯ আমাকে দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। একই দিন শান্তির বাজারের মুদি দোকানদার মামুনকেও আটক করা হয়। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বলে হাজতে রেখে, আমাদের মানসিক নির্যাতন করে পুলিশ। ওই রাতে আমার অভিভাবক থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মামুনের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়।’
কামাল বলেন, ‘আমার বাবা ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি। আমরা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। অথচ খোদ আমরাই পুলিশের কাছে জিম্মি। আমার বাবা বাদি হয়ে মামলা করতে গেলে সুদ্বীপ রায় ‘এফ আই আর খরচ বলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। মুখ খুললে পুলিশ আরও বিপদে ফেলবে এজন্য কোনদিন মুখ খুলেনি।’ নিউ মার্কেট পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি নুরুল আলম পাটোয়ারি অভিযোগ করেন, ‘আমাকেও অযথা ধরে নিয়ে জিম্মি করে ২ লাখ টাকা আদায় করেছে ওই ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায়। তখনকার ওসি এম এম মুর্শেদসহ দুজন মিলে আমাকে অস্ত্র মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন। গেল সংসদ নির্বাচনের ক’দিন আগে পুলিশ আমাকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে থানায় নিয়ে এ হয়রানি করেছে।
আমার কষ্টের টাকা পুলিশ হাতিয়ে নিয়েছে।’ জানা যায়, একই মাসের ২৭ তারিখে উত্তর কুহুমা মজুমদার বাড়ি জামে মসজিদের সাবেক খতিব মাওলানা আবদুল মতিনকে আটক করে ৪০ হাজার, লক্ষীপুরের আনোয়ার হোসেনকে আটক করে ৫০ হাজার, ৩১ মার্চ শহরের ব্যবসায়ী ফজলুল করিমকে আটক করে ৫০ হাজার, মোকামিয়ার হাসেম মেম্বারের ছেলেকে আটক করে ৩ লাখ টাকা, লক্ষীপুরের সবুজকে আটক করে ১ লাখ ৫০ হাজার, বাঁশপাড়ার রাজনকে আটক করে ৩০ হাজার, একই গ্রামের ইকবালকে আটক করে ২ লাখ, দক্ষিন কুহুমার কালা মিয়ার ছেলেকে আটক করে ৪০ হাজার, শুভপুরের কালামকে আটক করে ১ লাখ টাকা আদায় করেন।
যশপুরের ব্যবসায়ী হায়দার জানান, তাদের প্রিয়া নামে তার এক আত্মীয় স্বামীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে এস আই জসিমকে দিয়ে, সুদ্বীপ রায় থানার ভেতর শালিশ বসান। শালিশে সংসার বিচ্ছিন্ন করার রায় দেন সুদ্বীপ রায়। পরে প্রিয়ার শশুরের কাছ থেকে কাবিনের ৫ লাখ টাকা আদায় করেন সুদ্বীপ। তিনি ‘শালিশ খরচ’ বলে প্রিয়ার কাবিনের দেড় লাখ টাকা মেরে দেন। বাকি সাড়ে ৩ লাখ টাকা প্রিয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে, এ নিয়ে সে যেন কোথাও ‘ টু’ শব্দ না শুনে, তা বলে শাসিয়ে দেন ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায়। একইভাবে বারইয়ারহাটের মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্রী নাছরিন আক্তারের বিয়ের কাবিনের টাকাও মেরে দেন সুদ্বীপ। ওই ছাত্রী জানান, সুদ্বীপ রায় তার পুরো সংসার জীবন তছনছ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘তার বিশ দিন বয়সী নবজাতককে আটক করে তার শশুর বাড়ির লোকজন, গত বছরের ১০ মে তাকে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেন।
তিনি সন্তান ফিরে পেতে ওইদিন ছাগলনাইয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। সন্তান উদ্ধারের পর সুদ্বীপ রায় তার স্বামী শশুরের পক্ষ নিয়ে তাকে, সংসার ভাঙার জন্য চাপ দেন। তিনি ভয়ে বাড়ি ছেড়ে তার নানার বাড়িতে আশ্রয় নেন। টের পেয়ে সুদ্বীপ রায় একদিন সাদা পোষাকে তার নানার বাড়িতে এসে তাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, জোর করে কাবিন নামায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন। তিনি শারিরীকভাবে ভীষণ অসুস্থ। কাবিনের টাকা ফেরত দিতে করজোড় করে বলার পরও তিনি, কাবিনের টাকার বড় একটা অংশ মেরে দেন। বাড়াবাড়ি করলে একাধিক মামলা হবে বলে হুমকি দেন।’
মটুয়া এলাকার রনি এবং সাখাওয়াত নামে দু যুবকের সঙ্গে মারামারির পাল্টাপাল্টি মামলা হয় থানায়। উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় বাদী বিবাদীর মধ্যে সমঝোতা হয়। মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারপরও পুলিশ তাদের হয়রানি করতে থাকে। পরে ওসি তদন্তকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে বলে ওই মামলার আসামিরা অভিযোগ করেন।
শুভপুরের কলেজ ছাত্র আবু রাহাত জানান, তিনি বিদেশ যাওয়ার জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের অনলাইনের আবেদনের কপি থানায় জমা দিতে গেলে, ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায় তার কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পর জানা যায়, যে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট তাকে দেয়া হয়েছিল, সেটি ছিল ভুয়া। পরে আবার আবেদন করে ওসি তদন্তকে ৩ হাজার টাকা দিলে, তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট তার হাতে তুলে দেন। যারা প্রতিবাদ করেছেন তারা বিভিন্ন মামলার আসামি হয়েছেন।
জানা যায়, সিএনজি গাড়ি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রন, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ইমা গাড়ির স্ট্যান্ড, অবৈধ বালু মহাল, কালোবাজারি, বড় বড় মাদক সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন অবৈধ সেক্টর থেকে তিনি নিজেই গিয়ে মাসোয়ারা নেন।
ওসি (তদন্ত)সুদ্বীপ রায়ের বিরুদ্ধে ছাগলনাইয়া এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ। তার বিরুদ্ধে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে, ভুক্তভুগীরা ও এলাকাবাসী মনে করেন।উল্লেখ্য, সম্প্রতি ফেনী জেলায় দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা অন্যত্র বদলী হলেও, দুর্নীতিবাজ ছাগলনাইয়া থানার ওসি (তদন্ত) সুদ্বীপ রায় এখনও বহাল তবিয়তে আছেন।
ওসি তদন্ত সুদ্বীপ রায় বলেন, আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। আমার বিরুদ্ধে কোথাও কেউ কোনদিন অভিযোগ করেননি। আমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য এসব বলা হচ্ছে। আমরা জনগনের সেবক। কারো কাছ থেকে ঘুষ নেয়নি। কেউ খুশি হয়ে পুলিশকে টাকা দিলে তা ঘুষের মধ্যে পড়েনা।’
ছাগলনাইয়া থানার ওসি মোঃ মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি যোগদান করেছেন সবে মাত্র মাস দুয়েক হলো। এগুলো হলেও আগে হয়েছে। এখন কোন অনিয়ম তার নজরে আসেনি।
সুদ্বীপ রায়ের ঘুষ দুর্নীতি সর্ম্পকে সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার ( ছাগলনাইয়া-পরশুরাম সার্কেল) নিশান চাকমা বলেন,‘ কোন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করলে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’