এ বাশার চঞ্চল, নওগাঁ প্রতিনিধি: প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এলাকায় দাঁপিয়ে পত্রিকা বিপনন করে আসছেন আলহাজ্ব সাবের আলী মাস্টার (৭৫)। বয়সের ভারে আগের মত আর দাঁপিয়ে বেড়াতে না পারলেও নিজের শখ ফুর্তি আর আনন্দ বােধের কারণেই জীবনের শেষ মূহুর্তেও প্রতিদিন প্রিয় পাঠকের মাঝে পত্রিকা পৌছে দিতে পারাটায় তার বড় আনন্দ। আর এই শখের বশেই পুরাতন এক সাইকেলের সহযােগীতা নিয়ে কাক ডাকা ভোর থেকে রােদ, ঝড়, বৃষ্টি, বাদলকে উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে দুপুর অবদি উপজেলা সদর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় পত্রিকা পাঠকের মাঝে প্রতিদিনের বিভিন্ন নামের আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকা পৌছে দেন তিনি। দুপুর একটু আরাম-আয়েশ করে আবার সেই সাইকেল নিয়ে পত্রিকা হাত নিয় আবার বেরিয়ে পড়েন। ব্যস্ততম সড়ক অন্যান্য যানবাহনের ভিড়ে সাইকেল চালানাের মত শারীরিক শক্তি না থাকলেও পায় হেঁটে সাইকেল ঠেলিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা মিলে প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজের দেহ মন আনন্দমুখাের রাখতই সাবর আলী পত্রিকা বিক্রয়র কাজর মধ্য নিজক জরিয়ে রাখে। প্রতিদিন খুব বেশি পত্রিকা বিক্রয় করতে না পারলেও তার নির্ধারিত প্রিয় গ্রাহকেরা সাবের আলী মাস্টার ছাড়া অন্য কারাে কাছ থেকে পত্রিকা নেয় না। প্রতিদিন সব মিলে তার আয় হয় মাত্র ৩০ টাকা। যা একটি সংসার চালানোর জন্য কিছুই না। তবুও তিনি ছাড়তে চান না এই আনন্দের পেশা।
জানা গেছে, নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার কাশিমপুর ইউপি’র চকমনু গ্রামের মৃত ওহির উদ্দিন শেখের বড় ছেলে আলহাজ্ব সাবের আলী মাস্টার। তিন ভাই দুই বােনের মধ্যে তিনিই বড়। পিতা-মাতার অভাবের সংসার পড়া-শুনার পাশাপাশি দিন মজুরির কাজ করে ১৯৬২ সালে এসএসসি পাশ করেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার কারণে ছাত্র জীবনেই সংসারের ঘানি টানার দ্বায়িত্ব তার কাঁধে পড়ে। এক পর্যায়ে লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে উপজেলার বিজয়কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন। অল্প বেতনের চাকুরী হওয়ায় সংসারে সচ্ছলতা আনার লক্ষ্যে তার এক বাল্য বন্ধ আশরাফ হােসেনের পরামর্শ ওই বছরেই ঢাকায় গিয়ে দৈনিক বাংলার বানী, ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ, সংগ্রাম সহ বেশ কয়েকটি শীর্ষ¯স্থানীয় পত্রিকার এজেন্ট নিয়ে রাণীনগরে পত্রিকা বিক্রয় ব্যবসা শুরু করেন। তৎকালিন সময় যােগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় ডাক যােগে তার নামে ঢাকা থেকে পত্রিকা আসতো। যার সময় লাগতো চার দিন।
দৈনিক পত্রিকা হলেও আলহাজ্ব সাবের আলী মাস্টার সেই সময় পাঠকের কাছ কয়েক দিন পরে পৌছালেও পত্রিকা পেয়ে পাঠকেরা বেজায় খুশি হয়ে নগদ টাকায় পত্রিকা কিনতো। কি বর্তমান সময় মূহুর্তের মধ্যে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌছে দিয়েও বাঁকি বয়কার কারণে এই ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তবুও লেগে আছি। ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকার এজেনন্ট তার নামেই রয়েছে। বয়সের কারণে বেশি দৌড়-ঝাঁপ না করতে পারাই তার ভাতিজারা এই ব্যবসা বর্তমানে পরিচালনা করছে। দাম্পত্য জীবনে তিনি তিন ছেলে তিন মেয়ের জনক। বর্তমানে বড় দুই ছেলে প্রায় ১০ বছর ধরে অ্যামেরিকা প্রবাসী। ছােট ছেলে ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে আইন বিভাগে পড়া-লেখা করছে। তিন মেয়ের মধ্যে ইতিমধ্যেই এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর দুই মেয়ে ঢাকায় পড়া-শুনা করছে।
সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ২০১৪ সালে হজ্ব ব্রত পালন করার পর ছেলেদের ইচ্ছায় স্বামী-স্ত্রী দুই জনেই আমরিকায় বসবাসের জন্য গেলেও আগের সেই পত্রিকা বিপননের পেশার টানে স্ত্রী ছেলেকে রেখে সপ্তাহ খানিক পরেই তিনি নিজ জন্ম ভূমি রাণীনগরে চলে আসেন এবং পত্রিকা বিপননের সাথে আবার জড়িয় পড়েন। তবে তার শেষ ইচ্ছা কোন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে অফিসে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বলবে, “আপনার বয়স হয়েছে আপনাকে আর এই পেশাই মানাই না তাই আপনার অবসর যাওয়ায় ভাল”। তাহলে হয়তো তিনি অবসর নিতে পারেন।