তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা ও প্রকৃতির প্রতিশোধ | বাংলারদর্পন

গাজী মোঃ হানিফ :

বাংলাদেশ ও তার অতি নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে বঙ্গোপসাগরের অবস্থিত সাড়ে ৩ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩ কিলোমিটার চওড়া পূর্বাশা/ নিউ মুর আইল্যান্ড/ দক্ষিণ তালপট্টি নামক ছোটো জনবসতিহীন সাগরমুখী দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন বিবাদ চলে আসছিল।

 

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলের উপকূলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উপকূলের কাছাকাছি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার থেকে দুই কিলোমিটার দুরত্বে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নামে এই দ্বীপটি জেগে ওঠে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে ১৯৭০ সালে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ভোলা সাইক্লোনের পরবর্তীকালে বঙ্গোপসাগরে এই দ্বীপটির আবির্ভাব। কিছুকাল পরে এটির অস্তিত্ত্ব সমুদ্রেগর্ভে বিলীন হয়। স্থায়ী জনবসতিহীন এই অঞ্চলে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অস্তিত্বের আশঙ্কা থাকায় বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার এটির সার্বভৌমত্ব দাবি করে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। যাহা আন্তর্জাতিক সালিশী আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

 

এই এলাকার বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা বিভাজক হাড়িয়াভাংগা নদীর মূলস্রোত যেহেতু দ্বীপের পশ্চিম ভাগ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, সেহেতু “নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখা নীতি” বা Thalweg doctrine অনুযায়ী বাংলাদেশ দ্বীপটিকে নিজ দেশের অন্তভুর্ক্ত বলে মনে করে থাকে। অপরদিকে ভারতের দাবি হচ্ছে, নদীর মূলস্রোত যেহেতু পরিবর্তনশীল। সার্বভৌমত্ব প্রদানের এই বিষয় এবং দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সীমা প্রতিষ্ঠাপন র‌্যাডক্লিফ লাইন পদ্ধতি অনুযায়ী বড় আকারের বিতর্কের অংশ হয়ে ওঠে এটি। তবে সম্প্রতি ২০১৪ সালে ৭ই জুলাই আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত এর রায় অনুযায়ী দ্বীপটি ভারতের সমুদ্র সীমায় পড়েছে এবং দ্বীপটি ভারতের অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

 

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই দ্বীপটির সন্ধান সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বীপটির বয়স ততদিনে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছিলো।

১৯৭৪ সালে একটি আমেরিকান স্যাটেলাইটে আড়াই হাজার বর্গমিটার এ দ্বীপটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। পরে রিমোট সেন্সিং সার্ভে চালিয়ে দেখা গিয়েছিল, দ্বীপটির আয়তন ক্রমেই বাড়ছে, একপর্যায়ে এর আয়তন ১০ হাজার বর্গমিটারে দাঁড়ায়।

 

তবে অনেকে দাবি করেন, ১৯৫৪ সালে প্রথম দ্বীপটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। দ্বীপটির মালিকানা বাংলাদেশ দাবি করলেও ভারত দ্বীপে নিজেদের দখল নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায় এবং সেখানে নৌবাহিনী ও বিএসএফ সদস্য মোতায়েন করে। ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে তারা এই দ্বীপে নিজেদের অধিকার সুসংহত করবার চেষ্টা চালায়। অবশ্য স্থায়ী কোনো স্থাপনা সেখানে গড়ে তোলা হয়নি।

 

মালিকানা দাবীর পক্ষে ভারতের যুক্তি, ১৯৮১ সালের আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টির পূর্ব অংশটির অবস্থান ভারতের দিকে, যা ১৯৯০ সালের ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটি চার্টেও স্বীকৃত।

 

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাঙালীদের নিহত হবার ঘটনা ও ছিটমহল বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তার উপর আবার নতুন গড়ে উঠা এই দ্বীপ নিয়ে বিরোধ সম্ভবত প্রকৃতির পছন্দ হয়নি। তাই ১৯৮৭ সালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে দেখা যায়, এই দ্বীপটি ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে। শেষমেশ ২০১০ সালে এই দ্বীপের আর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

মার্চ, ২০১০ এ বিবিসি খবর অনুযায়ী দ্বীপটি বর্তমানে ২ মিটার সমুদ্রতলে নিমজ্জিত। এটি প্রকৃতির প্রতিশোধ নয় কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *