নকিপুর জমিদার বাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত 

শেখ আমিনুর হোসেন, সাতক্ষীরা ব্যুরো চীফ:

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর জমিদার বাড়িটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কার ও রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে বাড়িটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। জানালা-দরজা না থাকায় বাড়িটি গোবাক্ষ রুপ নিয়েছে। বাড়ির দেয়ালে জন্ম নিয়েছে শতশত বটবক্ষ। নোনা ধরে ইটের দেয়াল খসে খসে পড়ছে। ইতিহাসের জীবন্ত উপাদান এ বাড়িটি রক্ষায় নেয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ।স্হানীয়রা মনে করেন নকিপুর জমিদার বাড়িটি ইতিহাস ঐতিহ্যর সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

শ্যামনগর থানা সদরের ২ কিলোমিটার পূর্বে জমিদার হরিচরণ রায়চৌধুরীর বাড়িটি ১৮৮৮ থ্রিষ্টাব্দ নির্মিত হয়। বিশাল আকারের তিনতলার ইমারতটি ভাঙাচোরা অবস্থায় এখন কোনরকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা প্রতাপাদিত্যর পরে হরিচরণ রায় ছিলেন শ্যামনগর অঞ্চলের প্রভাবশালী ও বিত্তশালী জমিদার। তার উদ্যোগে শ্যামনগর তথা সমগ্র সাতক্ষীরায় অনেক জনহিতকর কাজ হয়েছিলো। অনেক জমিদারের মতো হরিচরণ রায় শুধু সম্পদ ও বিলাস মত্তে ছিলেন না। রাস্তাঘাট, খাল খনন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ নির্মিত হয়েছিলো নকিপুর মাইনর স্কুলটি। যেটি বর্তমান নকিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে খ্যাত। জমিদার বংশের লোকজন ১৯৭১ সালে সবাই চলে যান ভারতে। তার পর থেকে ঐ স্হানটি পরিণত হয়েছে ভূতুড়ে বাড়িতে। জমিদারবাড়ির সব জিনিসপত্র চলে গেছে চোর ও লুটদারের দখলে। তবে পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি, এর পাশ্বের দুর্গামন্ডপ, নেহবতখানা, শিবমন্দির, জলাশয় ইত্যাদি দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত জৌলুস।

দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যর রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট এলাকায়। তাঁর রাজত্বের প্রায় ২৫০ বছর পর জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী শ্যামনগরের নকিপুর একছত্র অধিপতি ছিলেন। শ্যামনগর সদ্য জাতীয়করণকৃত নকিপুর এইচ.সি (হরিচরণ চৌধুরী) পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর বসতবাড়িটি যা দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্হাপত্য হিসেবে পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতো তা আজ সংস্কার ও দূরদর্শীতার অভাবে ধংসের দ্বারপ্রান্তে।

 

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও লেখক চারু চন্দ্র মন্ডলের লেখা একটি বই থেকে জানা যায়, জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরীর বাড়িটি ছিল সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর। যার বাউন্ডারীটি ছিল প্রায় দেড় হাত চওড়া প্রাচীর দ্বারা সীমাবদ্ধ। সদর পথে ছিল একটি বড় গেট বা সিংহদ্বার। সম্মুখে ছিল একটি শান বাঁধানা বড় পুকুর। শতাধিককাল পূর্ব খননকৃত এই পুকুরটিতে সারাবছরেই জল থাকে এবং গ্রীষ্মর দিন প্রচন্ড তাপদাহে তা শুকায় না।

পুকুরঘাটর বাম পাশে ছত্রিশ ইঞ্চি সিঁড়ি বিশিষ্ট দ্বিতল নৈহবত খানা। আটটি ইম্ভো বিশিষ্ট এই নৈহবত খানার ধংসাবেশেষটি এখনও প্রায় অক্ষত অবস্থায় দন্ডায়মান থেকে কালের স্বাক্ষী বহন করছে। বাগান বাড়িসহ মোট বার বিঘা জমির উপর জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিলো। বাড়িটি ছিলো সত্তর গজ লম্বা, তিন তলা বিশিষ্ট ভবন। সদর দরজা দিয় ঢুকতেই সম্মুখে সিঁড়ির ঘর। নিচের তলায় অফিসাদি ও নানা দেবদেবীর পূজার ঘর, এছাড়া আরও দুইটি গমনাগমন সিঁড়ি পথ। মাঝের তলায় কুল দেবতা গোপাল দেবের মন্দির ও অতিথি শালা। সিঁড়ির দু’পাশে কক্ষ ছিল এবং সিঁড়ি ছিল মধ্যবর্তী স্থান। সদর অসদরের দুই পাশেই বারান্দা ছিল। বারান্দা গুলি বেশ প্রশস্ত আট ফুট চওড়া।

বিল্ডিং এর নীচে আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল। সেগুলি ভাড়ার ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হতো। নিচের তলায় ১৭টি এবং উপরের তলায় ৫টি কক্ষ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ছোট, বড়, মাঝারি সব রকমের কক্ষ ছিল। বিল্ডিংটির দৈর্ঘ্য ২১০ ফুট, প্রস্তো ৩৭ ফুট, পুন: ৬৪ ফুটের মাথায় এল প্যাটানের বাড়ি। প্রথমবার ঢুকলে কোন দিকে বহির্গমন পথ তা বোঝা বেশ কষ্টদায়ক ছিলো। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লৌহ কাষ্ঠের দরজা-জানালা ও বর্গাদি, লোহার কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাঁদ, ভিতরে কক্ষে কক্ষে গদি তোষক, কার্পেট বিছানো মেঝে, এক কথায় জমিদার পরিবেশ, যেখানে যেমনটি হওয়া দরকার তার কোন ঘাটতি ছিলো না। বাড়িতে ঢুকতে ৪টি গেট ছিলো। গেট ৪টি ছিলো ২০ ফুট আর। জমিদার বাড়ির দক্ষিণে একটি বড় পুকুর ছিলো। ১৯৫৪ সালের জমিদার পরিবার এখান থেকে স্ব-পরিবারে ভারতে চলে যায়।

বর্তমান সে পুকুরটি আর নেই। নেই পূর্বের মত সৌন্দর্য। তবে তার দক্ষিণে এখনও একটি পুকুর বিদ্যমান যার শান বাঁধানো ঘাটের ধংসাবিশেষটির দুই পাশে দুটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

শ্যামনগরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুজন সরকার বলেন, ইতিমধ্যে জমিদার বাড়িটির অবৈধ দখলমুক্ত এবং জমি প্রাঙ্গণ অবৈধ দখলকারীদের স্ব-উদ্যোগে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে আদালতে মামলা থাকায় একজনকে উচ্ছেদ করা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আবদুস সামাদ ইতিপূর্বে স্ব-স্ব উপজেলার ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্হান সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি কর্মকর্তাগণকে নির্দশনা প্রদান করেন। তারই নির্দশনা মতে নকিপুর জমিদার বাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান বাড়িটিকে পূর্বের নান্দনিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। জমিদার বাড়িটির চারপাশে বেষ্টনি দেওয়ার চেষ্টা করেছি যেন কেউ এই নিদর্শনের কোন কিছুই নষ্ট করতে না পারে।

 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল জানান, নকিপুর জমিদার বাড়িটি সাতক্ষীরার একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্হান। এ বাড়িটি আমাদের দেড়শ’ বছর আগের কথা মনে করিয়ে দেয়। তৎকালীন জমিদার বংশের গৌরবময় ঐতিহ্যর নানা নির্দশন পাওয়া যায় এ বাড়িতে। বাড়িটি সংরক্ষণে ইতামধ্যো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *