টেকনাফে ভয়াবহ ইয়াবা নেটওয়ার্ক বিশিষ্টজনেরাই গডফাদার, ঘরে ঘরে মাদক ব্যবসায়ী

নিউজ ডেস্ক :

আবদুর শুক্কুর, মুজিব ওরফে মৌলভি মুজিবুর রহমান ও আবদুল আমিন। গ্রামের বাড়ি তাদের টেকনাফ সদরে।

এরা সবাই কোটিপতি। তবে এদের আরও বড় পরিচয়, এ তিনজন কক্সবাজারের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির আপন ভাই। আর জাফর আহমেদ? উপজেলা চেয়ারম্যান তিনি। একসময়ের টেকনাফ বিএনপির ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি এখন সরকারি দলের বড় নেতা। এরা প্রত্যেকেই টেকনাফের বিশিষ্টজন। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণকারী। এরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবার গডফাদার। তালিকার প্রথম নামটি জাফর আহমেদ হলেও তিনি ভোট করে চেয়ারম্যান হয়েছেন টেকনাফের। এরা প্রত্যেকে এমনই ক্ষমতাধর যে এদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও কাজে আসে না।

তাদের আইনের আওতায় আনতে দুই বছর আগে মন্ত্রণালয় থেকে নামের তালিকা পাঠালেও কক্সবাজার জেলা পুলিশ কিছুই করেনি। তবে এ তালিকার সাত নম্বরে যার নাম রয়েছে, তিনি হলেন জাহেদ হোসেন ওরফে জাকু। তালিকায় তার পরিচয় লেখা রয়েছে এমপি বদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে। গতকাল ভোরে টেকনাফে বিজিবি-র্যাবের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বন্দুকযুদ্ধে যে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন এই জাকু। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, টেকনাফের এমন ৬৯ বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, যারা সারা দেশের ইয়াবার নিয়ন্ত্রণকারী। মাদকের স্বর্গরাজ্য টেকনাফ থেকে এরা দেশের ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এদের তত্ত্বাবধানেই টেকনাফে এখন ঘরে ঘরে ইয়াবা ব্যবসায়ী। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তালিকা অনুযায়ী এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ শতাধিক। এক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ উপজেলার বেশির ভাগ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যারা ইয়াবা ব্যবসা করেন, তাদের চেয়ে যারা ব্যবসা করেন না, তাদের তালিকা করাই সহজ। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পরিচয়। তারা কেবল ব্যবসায়ী নন, সরাসরি ইয়াবার আমদানিকারক। তারা এতটাই ক্ষমতাধর যে, প্রশাসন তাদের কাছে অসহায়।

টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ইয়াবার বাংলাদেশের গডফাদার এমপি বদির পরিবারের হাতে। এ ছাড়া রয়েছেন আরেক গডফাদার, যিনি ইয়াবা ব্যবসার জন্য বাড়িঘর করেছেন মিয়ানমারে। তিনি হলেন সাইফুল করিম। এই সাইফুল করিম ইয়াবা ব্যবসায় এ মুহূর্তে শীর্ষস্থানে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এমপি বদি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ থাকায় বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, এমপির সঙ্গে সব সময় চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাফেরা। এমপির ভাই, বন্ধু ও সহযোগীরা বেপরোয়া ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি এমপির ক্ষমতার জোরেই চলছে, এ কথা সবাই জানে। এমপির এই ইয়াবা ব্যবসার কথা জানে সরকার ও দল। এর পরও তারা কিছু করছে না। তিনি বলেন, যারা ওপরের নেতা রয়েছেন, তারাও মাসহারা নিচ্ছেন। এখানকার সাধারণ মানুষ এমপি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে অসহায়। মাঝেমধ্যে পুলিশ অভিযান চালায়। ক্রসফায়ার হয়। কিন্তু বড় মাছগুলো সব সময় থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিগত মহাজোট সরকারের আমল থেকে এ পর্যন্ত সীমান্ত জনপদ টেকনাফ ও কক্সবাজারের বাস্তবতা এটাই। আর এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা কোনো কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ কারণে তারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে পারছেন না। কেননা ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো নিজেকে হয়রানি হতে হবে। এ কারণে তারা এসব ঝামেলায় যেতে চান না। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা দেশের ৩১ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় আবদুর শুক্কুরের নাম ১৯ নম্বরে এবং ২০ নম্বরে মুজিব ওরফে মৌলভি মুজিবুর রহমানের নাম। এ ছাড়া বিজিবির তৈরি করা ৬৯ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকার ২ নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে আবদুল আমিনের নাম।

সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৩১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নামের তালিকাসহ একটি বিশেষ প্রতিবেদন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। প্রতিবেদনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে ২০০০ সালে টেকনাফের বাসিন্দা রমজান আলী ওরফে একটেল রমজান এবং শুক্কুর ওরফে বার্মাইয়া শুক্কুরের (এমপি বদির ভাই) মাধ্যমে দেশে ইয়াবা ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটে। পরবর্তীকালে এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইয়াবা ব্যবসা করে অনেকেই এখন কোটিপতি। তালিকার ১ ও ২ নম্বরে আছে যথাক্রমে মোস্তাক আহমদ ও দিদার হোসেনের নাম। এরা টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে। জাফর আহমদ উখিয়া-টেকনাফের এমপি বদির একান্ত ঘনিষ্ঠজন ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী বলে জানা গেছে। এরপর ৭ নম্বরে আছেন জাহেদ হোসেন ওরফে জাকু। প্রতিবেদনের মন্তব্যঘরে তার পরিচয় লেখা হয়েছে, তিনি স্থানীয় এমপি আবদুুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৫ নম্বরে আছে এমপির ঘনিষ্ঠ স্বজন পিচ্চি আনোয়ারের নাম। ১৬ নম্বরে যার নাম আছে, তিনি বদির কাছের লোক টেকনাফ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সফিক মিয়ার জামাই। ১৯ ও ২০ নম্বরে আছে আবদুর শুক্কুর ও মুুজিব ওরফে মৌলভি মুজিবুর রহমানের নাম। তালিকায় তাদের পরিচয় লেখা- এরা স্থানীয় এমপির ভাই। তালিকার ২৪ নম্বরে আছেন একরামুল হক। সূত্র জানিয়েছে, এমপি বদির সার্বক্ষণিক সঙ্গী এই একরামুল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় একরামুলের পরিচয় লেখা, তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। তালিকার ২৫ নম্বরে থাকা আনোয়ার হচ্ছেন এমপির বন্ধু। এ ছাড়া তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে অন্য যাদের নাম রয়েছে, তারা হলেন- মৌলভি বোরহান, সিরাজ মিয়া, সামসুন্নাহার ওরফে জ্যোতি, আবদুল্লাহ হাসান, নুরুল আমিন, সৈয়দ আলম, মোহাম্মদ কামাল হোসেন, জহির, জাফর নূর আলম, আবদুুর রহমান, তৈয়ব মিয়া, কবির আহমেদ ওরফে ইয়াবা কবির, ইব্রাহিম, আলম, নূর মোহাম্মদ, জামাল, ছোটন, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ, জাকির হোসেন ও রমজান ওরফে একটেল রমজান।

মিয়ানমারের কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা ট্যাবলেট বাংলাদেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশেরই কিছু লোক নিয়েছেন ডিলারের দায়িত্ব। আর এরাই সারা বছর বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের পুরো নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছেন চারজন। এরা হলেন- টেকনাফ এলাকার শফিউর রহমানের ছেলে আলম। তিনি ইয়াবা ব্যবসার সুবিধার্থে রীতিমতো মিয়ানমারের মংডু জেলার ম্যাংগোলা গ্রামে বাসাবাড়ি করে বসেছেন। বছরের প্রায় ছয় মাসই থাকেন সেখানে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আলম ইয়াবা ট্যাবলেটের প্রধান এজেন্ট। অন্য ডিলাররা হলেন- আকিয়াব জেলার মংডু থানার ফয়েজপাড়া গ্রামে বসবাসকারী কেফায়াত আলীর ছেলে মো. সৈয়দ, গজুবিল গ্রামে বসবাসকারী মৃত খল আহম্মেদের ছেলে কালা সোনা ও বড়গজুবিলং গ্রামে বসবাসকারী আবদুল মোতালেবের ছেলে মোহাম্মদ নূর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *