ইরান ও পাকিস্তানকে সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করবে রাশিয়া – চীন

আনোয়ারুল হক আনোয়ার : আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ইরান ও পাকিস্তানকে সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করবে রাশিয়া ও চীন । বিষয়টি অনেকের কাছে বোধগম্য না হলেও বাস্তবে সেটাই ঘটছে । রাশিয়া ও চীনের এ মিশনটি অনেকদূর এগিয়েছে । ইরানের পারমানবিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে যখন আমেরিকাসহ পশ্চিমারা তেহরানের উপর হামলার ছক কষছিল । ঠিক তখন রাশিয়া ও চীন একজোট হয়ে ইরানের সাথে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমানু শান্তিচুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করে । আবার আমেরিকা, সৌদী আরব, কুয়েত ও কাতার সৃষ্ট আইএস যখন সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে। তখন রাশিয়া, চীন ও ইরান একজোট হয়ে সিরিয়ার মাটি থেকে আইএসকে প্রতিহত করে। পাকিস্তানের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল রাহিল শরিফসহ উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা মস্কো সফরকে ফলপ্রসু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর কয়েক সাপ্তাহ পর রাশিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতের অনুরোধ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের মাটিতে রাশিয়ান সেনাদের যৌথ সামরিক মহড়া নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস । বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়া ও চীন পৃথক পৃথকভাবে অনুধাবন করে যে, উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিনীদের আধিপত্য রোধকল্পে ইরানের সহযোগীতা প্রয়োজন । তেমনিভাবে উদীয়মান শক্তি ভারতকে চাপের মুখে রাখতে পাকিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। সে লক্ষে হাঁটছে রাশিয়া ও চীন ।
ইরান : মধ্যপ্রাচ্যে ইরান একক পরাশক্তি হিসেবে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে । দীর্ঘ ত্রিশ দশকের পশ্চিমা অবরোধের মাঝেও ইরানের অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রযাত্রা পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায় । তাই সিরিয়ায় আইএসকে ব্যবহার করে বাসার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে পশ্চিমারা ছিল বদ্বপরিকর । বাসার আল আসাদের পতন ঘটলে পরবর্তীতে ইরানে হামলার লক্ষ্যস্থল ছিল । কিন্তু রাশিয়া ও চীনের অংশগ্রহনের সুবাদে পশ্চিমাদের আশায় গুঁড়ে বালি । একই সময় সৌদী আরব ইয়েমেনে হামলা শুরু করে । উদ্দেশ্য ছিল মাত্র কয়েক সাপ্তাহের মধ্যে বিরোধীদের পতন ঘটানো । কিন্তু সৌদী রাজ পরিবারের আইএস ও ইয়েমেন মিশন চরমভাবে ব্যর্থ হয় । উপরোন্ত ইয়েমেনের একটি দূর্বল গোষ্ঠীর নিকট সৌদী সেনারা প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে । ফলে সৌদীদের সামরিক শক্তি সামর্থ নিয়ে মুখরোচক গল্প বেরিয়েছে। সিরিয়া ইস্যুতে বাসার আল আসাদ সরকার এ যাত্রায় রক্ষা পায় । কিন্তু পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকার কোন আলামত দেখা যাচ্ছেনা । বিশ্বের প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিন বিষয়টি অনুধাবন করে ইরানকে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান করার উদ্যোগ নিয়েছে । ইরান ইতিমধ্যে শক্তিশালী এস – ৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপনাস্ত্রের দুইটি চালান গ্রহন করেছে । এছাড়া রুশ সরকার ইরানকে আধুনিক জঙ্গী বিমান এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করবে। উল্লেখ্য, ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তিতে ইরান এমনিতেই এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া দেশটি সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, প্রশিক্ষন বিমান, ড্রোন, হেলিকপ্টার, বোমারু বিমান, রাডার সিস্টেম, সেনা ও নৌবাহিনী জন্য অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরীতে সক্ষম হয়েছে ।
উপসাগরীয় প্রায় সবক’টি দেশে আমেরিকার বেশ কিছু সামরিক ঘাঁটি রয়েছে । উল্লেখিত দেশগুলো সামরিক ঘঁটিসমূহের খরচাপাতি বহন করে আসছে । এসব সামরিক ঘাঁটি থেকে রাশিয়া, চীন, ইরান ও সিরিয়ার উপর সামরিক গোয়েন্দাগিরি পরিচালিত হচ্ছে । এছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে কোটি কোটি টন তেল আমেরিকায় সরবরাহ হচ্ছে । বর্তমানে সৌদী আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমানের সাথে আমেরিকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য চলছে । প্রতি বছর এসব দেশ আমেরিকা থেকে কয়েক হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে । ফলে মার্কিনীদের নিকট উপসাগরীয় পাঁচটি দেশ হচ্ছে, সোনার হরিণ সমতূল্য । মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের একক আধিপত্য মেনে নিতে পারছেনা রাশিয়া ও চীন । আবার মার্কিনীরা এসব আরব দেশকে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্বে ব্যবহার করে আসছে । ফলে ইরানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে রাশিয়া ও চীন । সিরিয়া যুদ্বে রাশিয়া, চীন ও ইরানের সামরিক কমান্ডারগন যৌথভাবে কাজ করার সুবাদে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্টতা আরো বৃদ্বি পায় । সিরিয়া যুদ্বের শেষ প্রান্তে এসে রাশিয়া ও চীন উপসাগরীয় অঞ্চল তথা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক গুরুত্ব অনুধাবন করে । আর তাই আনুষ্ঠানিক ঘোষনার মাধ্যমে ইরানকে সামরিক ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে রাশিয়া । ইরান রাশিয়ার সামরিক সহযোগীতা লাভ করলে উপসাগরীয় দেশগুলো চরম উদ্বেগের মধ্যে থাকবে । অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে আর কোন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালানোর ঝুঁকি নিতে চাইবেনা ।
পাকিস্তান : আফগানিস্থান থেকে সৌভিয়েত সেনাদের হটাতে সিআইএ পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে । এসময় সিআইএর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে আল কায়দা ও তালেবানসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গীগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় । অবশেষে রুশ সেনারা আফগান মাটি ত্যাগ করলে দেশটি মূলত: সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে । আফগান যুদ্ব পরবর্তী প্রায় এক দশক রাশিয়ার সাথে পাকিস্তানের তেমন একটা সূ-সম্পর্ক ছিলনা । সিরিয়া যুদ্বের মাধ্যমে পাক-রুশ সম্পর্কে বরফ গলতে থাকে । এছাড়া রুশ -পাক সম্পর্ক উন্নয়নে চীন নেপথ্যে কাজ করে । অপরদিকে চীন -পাকিস্তান হচ্ছে একে অপরের বিস্বস্থ মিত্র । যাকে বলে কিনা মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ । গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট ইসলামাবাদ সফরকালে পাক সিনেটের যৌথ অধিবেশনে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, এক সময় বিশ্বে চীন যখন নি:সঙ্গ ছিল তখন পাকিস্তান ছিল একমাত্র পরীক্ষিত বন্ধু । সুতরাং বন্ধুদেশের যে কোন প্রয়োজনে চীনারা সজাগ রয়েছে । চীনা প্রেসিডেন্টের ভাষনের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইসলামাবাদ ও বেজিং এর মধ্যে আট হাজার কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর হয় । এক কথায় পাকিস্তানের বিধ্বস্থ অর্থনীতিকে উদ্বার করেছে বন্ধুদেশ চীন । পাকিস্তানের গোয়াদা সমুদ্র বন্দর, কারাকোরাম সড়কসহ চীনের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উন্নয়ন এবং বিদ্যুত ও জ্বালানীখাতসহ অন্তত ৮টি প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের পরিমান ১২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে । চীনাদের আর্থিক সাহায্যে পাকিস্তানীরা এক প্রকার প্রাণ ফিরে পেয়েছে । অপরদিকে পাকিস্তানের গোয়াদা সমুদ্র বন্দর এবং পাক-চীন দুইটি সড়ক পথকে ভারত হুমকি মনে করছে । ফলে শুরু থেকে ভারত এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে ।
পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের ৭৫% চীন যোগান দিয়ে আসছে । অপরদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোর চীন-ভারত সম্পর্ক চরম ঝুঁকির মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে । পাক – ভারত সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলে চীন-ভারত সীমান্তে চীনা সেনা সমাবেশ ভারতের জন্য নতুনভাবে উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে । চীন তিব্বতের একটি বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে উপরোন্ত অরুনাচল প্রদেশটিও চীনের অংশ বলে দাবী করছে । ফলে ভারত এখন পাক – চীন উভয় সংকটে রয়েছে । ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমাদের সাথে সূ-সম্পর্ক গড়ে উঠে । এক সময় ভারতের সামরিক সরঞ্জামের ৮০% যোগানদাতা ছিল রাশিয়া । কালের বিবর্তনে রাশিয়ার পরিবর্তে পশ্চিমারা এখন ভারতের প্রধান অস্ত্র যোগানদাতা । এছাড়া নরেন্দ্র মোদী সরকার অস্ত্র নির্মাণে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিতে চায় । গত তিন বছর ভারতের সামরিক বাহিনীতে আত্যাধুনিক যুদ্ব সরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে । এছাড়া দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিক শক্তি বৃদ্বিতে কাজ করে যাচ্ছে । ভারত ইতিমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে । এরমধ্যে চীনে আঘাতে সক্ষম ক্ষেপনাস্ত্রও আয়ত্ব করেছে । এক কথায় চীন এখন ভারতকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ভাবছে । আর তাই ভারতের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করছে চীন । কয়েকদিন পূর্বে করাচী সমূদ্র বন্দরে চীনা আত্যাধুনিক পরমানু সাবমেরিন নোঙ্গর করে । পাকিস্তান ক্ষেপনাস্ত্র সজ্জিত রণতরী নির্মাণে হাত দিয়েছে । চলতি বছর চীন থেকে আটটি সাবমেরিন যুক্ত হচ্ছে পাক নৌবহরে । পাক-চীন যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন মডেলের যুদ্ব বিমান নির্মিত হচ্ছে । এক কথায় পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের ৭৫% চীন যোগানে দিচ্ছে । পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী আধুনিকায়নে চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞদল কাজ করছে । পাক-চীন কারাকোরাম সড়ক এবং গোয়াদা বন্দর – চীন সড়ক নিয়ন্ত্রন করছে পাক-চীন স্পেশাল ফোর্স । এক কথায় রাশিয়া ও চীনের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে ইরান ও পাকিস্তান সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হচ্ছে । ইরান ও পাকিস্তানকে সামরিক খাতে শক্তিশালীকরনের মাধ্যেমে রাশিয়া ও চীন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের অবস্থান আরো সূদৃঢ় করতে চাইছে । ফলে আগামীতে আরো নাটকীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবে বিশ্ববাসী ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
Related News

সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী সোসাইটির’ উদ্যোগে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন | বাংলারদর্পণ
গোলাম ফারুক >> যুক্তরাজ্যে ‘সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী সোসাইটি’ উদ্যোগে ভ্যার্চুয়াল অনুষ্ঠান ‘মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি’(২০২১)Read More