শেখ মুজিব যেভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন

 

জিপু বিশ্বাস >

ঐতিহাসিক ২৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।আজকের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এর বিশাল গনসংবর্ধনায় তৎকালিন ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।দিনটি জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন।

শেখ মুজিবুর রহমান যৌবনের প্রায় চৌদ্দটি মূল্যবান বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন। প্রিয় মাতৃভূমি, স্বদেশ প্রেম আর বাংলার জনগণের জন্য ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।পাকিস্তান শাসকদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে ছিলেন অবিচল একজন মানুষ।কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা দেশের জনগণের অধিকার নিয়ে থেকেছেন সচ্চার।সেই নেতাকে সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করতে ভুলেননি ছাত্র সমাজ।

শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বসে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ নামে মামলা দায়ের করা হয়। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত।তবে এই মামলায় ৩৫ জনকে আসামী করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটিকে সরকারিভাবে নামকরণ করেছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার। ৩৫ জন আসামীর সকলেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।

মূলত বাঙ্গালী জাতির মুক্তিরসনদ ৬ দফা দেয়ার অপরাধেই বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সর্বমোট ৩৫ জনকে ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়।আবারও ক্ষমতায় আরোহণের জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন তৎতকালিন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান।আইয়ুব খানের এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর ব্যানারে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ’৬৯-এর গণআন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

১৭ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ১৯৬৯-এর ২০ জানুয়ারি তীব্র আন্দোলনের মুখে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। ২৪ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তাক্ত জামা হাতে নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হন মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর।তাদের রক্তের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান রূপ নেয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করে ছাত্র সমাজ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে।হত্যার পর আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন জারি করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান করেন ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। বাধ্য হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

এক সাক্ষাতকারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘‘বস্তুত, ’৬৬-এর ৮ মে’র গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে যে মুজিব গ্রেফতার হয়েছিলেন, ৩৩ মাস পর ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যে মুজিব মুক্তিলাভ করেন- নাম বিচারে এক হলেও বাস্তবে ওই দুই মুজিবের মধ্যে ছিল গুণগত ফারাক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ফাঁসিকাষ্ঠের বন্দিদশা থেকে মুক্ত মহামানব হয়ে বেরিয়ে আসেন। ২২ তারিখ আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাব। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩ টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।”

১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এর বিশাল গনসংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

তিনি শুধু বাঙালি জাতিরই মহান নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে মহান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *