এশিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ ও অপ্রত্যাশিত সাফল্যের নাম বাংলাদেশ

মন্তব্য প্রতিবেদন :

ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে ‘চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত’ সাফল্যের কাহিনীগুলোর একটি। ‘হোয়াই বাংলাদেশ ইজ বুমিং’ নামে তাঁর লেখাটি সোমবার প্রকাশ করেছে ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’ নামের একটি ওয়েবসাইট।

এই লেখায় তিনি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন।

সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একসময়ের দারিদ্র্য আর দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এই দেশটি এখন শুধু পাকিস্তানকেই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসুর এই লেখাটি গতকাল প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। কৌশিক বসুর মতে, মাত্র ১২ বছর আগে ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এতটাই হতাশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল যে, সে বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন পাকিস্তানেরটা ছাড়িয়ে গেল, তখন সেটিকে একটি ‘অঘটন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সেই বছরটাই ছিল আসলে বাংলাদেশের ‘টার্নিং পয়েন্ট’।

তিনি বলেছেন, ২০০৬ সাল হতে পরবর্তী প্রতিটি বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল পাকিস্তানের চেয়ে মোটামুটি আড়াই শতাংশ বেশি। আর এ বছর তো এটি ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে এটি ভারতের অর্থনীতির শ্লথগতির কারণেই ঘটবে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ কীভাবে এই অসাধারণ কাজটি করল, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন কৌশিক বসু।

তিনি স্বীকার করছেন যে, এর সুনির্দিষ্ট উত্তর কারও কাছে নেই, কারণ এ ধরনের ব্যাপক ঐতিহাসিক বিষয়ে সেটা থাকেও না। কিছু ‘ক্লু’ বা সূত্র খোঁজা যেতে পারে মাত্র। তার মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পালাবদলের পেছনে বড় ভূমিকাটি পালন করেছে সামাজিক পরিবর্তন— বিশেষ করে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন।

এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার কথা। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারও নারী শিক্ষার প্রসার এবং সমাজে মেয়েদের ভূমিকা জোরালো করতে ব্যাপক ভূমিকা নিয়েছে। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলছেন, এর ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু পৌঁছে গেছে ৭২ বছরে, যেখানে ভারতে তা ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৬ বছর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পালাবদলে কৌশিক বসু দ্বিতীয় যে কারণটির কথা উল্লেখ করছেন, সেটি গার্মেন্ট শিল্প। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ যে ভারতের তুলনায় গার্মেন্ট শিল্পে অনেক বেশি ভালো করেছে, এর পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রম আইন। তার মতে, ভারত এবং পাকিস্তানের যে শ্রম আইন, তা নানাভাবে এই দুই দেশের কারখানা মালিকদের শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এর ফলে এসব দেশের কারখানাগুলো খুব বড় আকারে করা যায়নি, সেখানে বেশি সংখ্যায় শ্রমিকও নিয়োগ করা যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কোনো আইনের অনুপস্থিতি বড় বড় গার্মেন্ট শিল্প স্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

আর ভবিষ্যৎ ঝুঁকির বিষয়ে কৌশিক বসু বলেছেন, এখনো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কিন্তু কিছু ঝুঁকি রয়েছে। যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার। তাঁর মতে, যখন কোনো দেশের অর্থনীতি ভালো করতে থাকে, তখন সেদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বৈষম্য— এসবও বাড়তে থাকে।

যদি এসবের রাশ টেনে ধরা না যায়, তা সমৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।

আর এর চেয়েও বড় ঝুঁকি হলো কট্টর ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীল শক্তি। এরা প্রগতিশীল সামাজিক খাতে বাংলাদেশের যে বিনিয়োগ, তার বিপক্ষে। যদি বাংলাদেশ এই বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়, সেটি বাংলাদেশকে আবার অনেক পেছনে নিয়ে যাবে। কীভাবে ইতিহাসে এরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে তার কিছু নজির তিনি টেনেছেন।

তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশ এই ধর্মীয় মৌলবাদ রুখে দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার এমন এক ‘সাফল্য কাহিনী’, যা দুই দশক আগেও ছিল অকল্পনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *