ঢাকায় বিশাল নাগরিক সমাবেশে শেখ হাসিনা ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়

নির্বাহী সম্পাদকঃ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা ১৯৭৫ সালের পরে অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিল, যাদের জন্ম বাংলাদেশে না, তারাই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারাই ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেছিল। সেই ভাষণ আজ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছিল তাদের কি লজ্জা হয় না?

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল শনিবার নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। প্রায় ২৫ মিনিটে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়। ইতিহাসও সত্যকে তুলে ধরে। আজকে সেই স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেয়েছে। বিশাল সমাবেশে তিনি আরও বলেন, আর যেন পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা, পদলেহনকারীরা ইতিহাস বিকৃতি করার সুযোগ না পায় সে জন্য সবাইকে জাগ্রত থাকতে হবে। এতদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আজ নতুন সূর্য দেখা দিয়েছে, নতুন প্রত্যয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ডস হেরিটেজ ডকুমেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি উপলক্ষে আয়োজিত এ নাগরিক সমাবেশে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিশিষ্ট নাগরিকেরা। ’৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, ঠিক তারপাশেই গড়া বিশাল এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সেদিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ৭ মার্চে ভাষণ দেওয়ার আগে বাবাকে আমার মা শোয়ার ঘরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি ১৫ মিনিট রেস্ট নাও। মা যখন তাকে ঘরে নিয়ে যান, তখন তার পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি (মা) বলেছিলেন, এই দেশের জনগণের জন্য তুমি সারাজীবন সংগ্রাম করেছো, আন্দোলন করেছো। অনেকে অনেক কথা বলবে, কিন্তু তুমি ভাষণে সেই কথাই বলবে, যেটা তোমার মনে আসবে। তুমি ভালো জানো কী বলতে হবে। এই দেশের মানুষের ভাগ্য তোমার হাতে।

এসময় তিনি আরও বলেন, মা রাজনীতি করেননি, কিন্তু তার রাজনৈতিক চেতনা ছিল প্রবল। তিনি এসব শিখেছেন আমার বাবার কাছেই। তিনি রাজনীতি বিষয়ে যখন যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা থেকে ভালো পরামর্শ আর হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তানের জান্তারা চায়নি বাংলাদেশের দায়ভার বাঙালির হাতে যাক। তারা বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার, মা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। ১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ছাত্রসমাজকে বার বার সংগঠিত করে এসেছেন। জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। লাখো মানুষ তখন এখানে এসেছিল। নৌকা নিয়ে, বাঁশের লাঠি নিয়ে। বাঙালি এসেছিলো জাতির পিতার কাছে দিক–নির্দেশনা নিতে। মায়ের কথা আজ বেশি মনে পড়ছে, যিনি ছায়ার মতো বাবাকে সমর্থন করছেন সবসময়। আর তার অবর্তমানে তার আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। নাগরিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এমিরেটাস অধ্যাপক অনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন রামেন্দু মজুমদার ও ডা. নুজহাত আলীম।

প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেলা তিনটার দিকে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছান। ৪টা ২০ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। শেষ করেন ৪টা ৫০ মিনিটে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের শুরুতেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। স্মরণ করেন ১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং জেলহত্যার শিকার চার জাতীয় নেতাকে।

সমাবেশস্থল সাজানো হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মতো করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কৃত্রিম লেকে শোভা পায় পাটবোঝাই পালতোলা নৌকা। আর নৌকার পালে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিভিন্ন অংশ। এসবের মধ্যে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’, ‘তোমাদের হাতে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ লেখা ব্যানার। সকাল থেকেই মুলত খ– খ– মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ, এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক ও ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যানার নিয়ে সমাবেশে আসতে শুরু করে। দুপুরের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে এ বিশাল উদ্যান।
জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হয়। এর পরই সমবেতভাবে দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন করা হয়। সমাবেশ চলাকালে নিমলেন্দু গুণ ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কবিতা পাঠ করেন। এ ছাড়া সমাবেশে বক্তব্যের মাঝে মাঝে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি ও লালন গীতি, ভাওইয়া পরিবেশন করা হয়। ফোকশিল্পী ও সাংসদ মমতাজ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গান পরিবেশন করেন। সমাবেশে প্রস্তাব পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। একই সঙ্গে তিনি ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টরের হাতে হস্তান্তর করেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ জাফর ইকবাল, ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টর বিএস কাললুল, প্রবীন সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার ও শিক্ষাবিদ শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আর যেন ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করতে না পারে সেজন্য সকলকে জাগ্রত থাকতে হবে। ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোতে স্থান পেয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাঙলা আজ আন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এ জন্য আমরা গর্বিত জাতি। এ উচ্চ শির যেন আর নত করতে না হয়। যারা এক সময় ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ করেছিল, আজ যখন এ ভাষণ ইউনেস্কোতে স্থান পেল তখন কি তাদের লজ্জা হয় না ? এ ভাষণের জন্য কত মানুষকে হত্য করা হয়েছে। কত মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছে। তারপরেও মানুষ থেমে থাকেনি। এ ভাষণ যতই বন্ধ করতে চেয়েছে ততই তা বেশি প্রচারিত হয়েছে। এ ভাষণ এত বেশিবার এত বেশিদিন এত বেশিঘণ্টা প্রচারিত হয়েছে, যা পৃথিবীর আর কোনও ভাষণ এত প্রচার হয়নি।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁর বক্তব্যে ইউনেসকো ও যে দেশগুলো ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন, যারা পাকিস্তানি নাগরিক তারা এ ভাষণ নিষিদ্ধ করতে পারেনি অথচ বাংলাদেশি পাকিস্তানি প্রেত্মাতারা এ ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল। ইতিহাস থেকে তারা জাতির পিতার নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তা পারেনি। প্রকৃত ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন প্রধামন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন প্রবীণ সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। দেশ বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।সমাবেশের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান মতে, মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ১০০ ভাষণের মধ্যে স্থান পেয়েছে এটি। তাই, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সারা পৃথিবীর সম্পদ।নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী ও নাজমুল হুদা : নাগরিক সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। সমাবেশে মঞ্চের সামনে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তাদের বসে থাকতে দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাদের সিদ্দিকী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মতপার্থক্যের কারণে দল ত্যাগ করে কৃষক–শ্রমিক–জনতা লীগ গঠন করেন তিনি। এরপর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের একজন কড়া সমালোচক। তবে বরাবরই তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার একনিষ্ঠ ভক্তির কথা প্রকাশ করে থাকেন। বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ২০১০ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)। পরবর্তী সময়ে তাকে বিএনএফ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। পরে গত মে মাসে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স–বিএনএ। তবে তাতেও তেমন সাড়া পাননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *