আমায় ক্ষমা কর পিতা : প্রবীর সিকদার

 

বাংলাদেশ বেতার কখন যে রেডিও পাকিস্তানের আদলে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে টেরই পাইনি! ওই রেডিও ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেই না, বলে ‘মজিবর রহমান’ ! খুন করেও যেন ওরা শান্তি পায়নি ! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন ওদের কাছে কৌতুকের পাত্র হয়ে গেছে ! তাই তো রেডিও বাংলাদেশ কখনো ‘মজিবর রহমান’, কখনো বা ‘শেখ মজিবর রহমান’ অবিশ্রাম বলে যায় ! আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৫ আগস্ট দুপুর গড়াতে না গড়াতেই খান আতাউর রহমানের লেখা ও সুরে মহিলা কণ্ঠে কিংবা কোরাস কণ্ঠে উপর্যুপরি পরিবেশন করা হয় মুজিব বিরোধী গান…… এতো দিন মহাজনী করেছে যারা / মুখোশ এবার তাদের খুলবোই……। ওই গানের কণ্ঠশিল্পী/শিল্পীদের নাম এবং গানের কলি হুবহু এখন আর আমি বলতে পারবো না। এতো দিন পরও একটি লাইনই কানে খুব বাজে… এতো দিন মহাজনী করেছে যারা……। রেডিওতে তখন ওই গানটি যতবার পরিবেশন করা হয়েছে, আমার ধারণা, রেডিওর জন্মের পর আর কোনও গান এতো বেশি সংখ্যক বার পরিবেশিত হয়নি। আর খান আতাউর রহমানেরও মেধার তারিফ করতে হয় ! ভদ্রলোক মেধাবীও বটে ! বঙ্গবন্ধুর রক্ত জমাট বাঁধতে না বাঁধতেই তিনি গান লিখে, সুর করে, শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দিয়ে রেকর্ডিং ও পরিবেশনা সম্পন্ন করে ফেলেছেন ! এটা খুব সহজ কাজ নয় ! উপর্যুপরি কান ঝালাপালা করা ওই গান শুনতে শুনতেই আমার মনে হয়েছে, খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে খুন করবার আগেই বোধকরি খান আতাকে গান তৈরির নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। নইলে খান আতা এতো তাড়াতাড়ি পারলেন কি করে !

একদিন আমার গ্রাম ফরিদপুরের কানাইপুর থেকে খবর এলো, একাত্তরের তুখোড় ছাত্রনেতা চিত্ত রঞ্জন পোদ্দার তথা চিত্ত কাকাকে থাপ্পর মেরেছে তারই জুনিয়র এক ছাত্রনেতা। ওই জুনিয়র নেতাটিও ছাত্রলীগের ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু খুনের দিন থেকে তিনি আর ‘মুজিব’ নামটি সহ্য করতে পারছেন না। খুনি জিয়া তার কাছে মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে গেছে ! উনি কেন চিত্ত কাকাকে থাপ্পর মারলেন ? চিত্ত কাকার অপরাধ, বাজারে চায়ের দোকানে বসে প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই থাপ্পর ঘটনার পর জুনিয়র ওই ছাত্রনেতা এলাকার বড় ফ্যাক্টর হয়ে গিয়েছিলেন। তার কথাতেই চলতো পুরো এলাকা ! তারপর চিত্ত কাকা অনেকদিন আর বাজারে আসতে পারেননি। পরে একদিন আমি গ্রামে গিয়েছিলাম। গোপনে দেখতে গিয়েছিলাম চিত্ত কাকাকে। আর প্রকাশ্যে দেখা করেছিলাম ওই দাপুটে ছাত্রনেতা বড় ভাইটির সঙ্গে। বাড়িতে মা, ঠাকুমা আর ছোট ছোট ভাইবোন থাকে- এটি মাথায় রেখে একটু বেশি বেশি খাতির করেই কথা বলেছিলাম তার সঙ্গে। আমিও বন্দী হয়েছিলাম ওই বিকৃত প্রভাব বলয়ে ! কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি !

পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *