ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর : ষড়যন্ত্রের ফাঁদে মুসলিম বিশ্ব

 

 

আনোয়ারুল হক আনোয়ার : যে মুহুর্তে স্বদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা তলানীতে ঠেকেছে অথাৎ ৩৮% মার্কিন নাগরিক তাকে পছন্দ করে ঠিক সে সময় তিনি সৌদী আরব সফর করে আশাতীত সফলতা অর্জন করেন । মুসলিম বিশ্বের কথিত মুরুব্বী সৌদী রাজ পরিবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জামাই আদরে বরণ করে । ইসলামি রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফের খাদেম বাদশা সালমান আবদুল আজিজ ও তার মন্ত্রীবর্গ ট্রাম্প পত্নী ও কন্যার সাথে করমর্দনসহ নানাবিধ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী । সৌদী আরব অবস্থানকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ৩৮ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি সম্পন্ন হয় । এরমধ্যে ১১ হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ক্রয় অন্যতম । ট্রাম্পের সন্মানে রিয়াদে ৫৬ জাতির আরব-ইসলামিক-আমেরিকান (এনআইএ) সম্মেলনের আয়োজন করা হয় । এতে ট্রাম্প তার বক্তব্যে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন এবং ইরানের বিরুদ্বে বিষেদাগার করেন । ট্রাম্প কন্যার একটি বিশেষ প্রকল্পে সৌদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কোটি কোটি ডলার প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়া হয় । এক কথায় অনভিজ্ঞ শাসক ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদী আরব সফরে পূরোপূরি কামিয়াব হন।

 

সৌদী উদ্যোগে ইতিপূর্বে গঠিত মুসলিম সামরিক জোটের কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা হয় । উক্ত জোটে অতিরিক্ত ৩৪ হাজার সেনা মোতায়েনের বিষয়ে কানাঘুষা চলে । এক কথায় এনআইএ সম্মেলন কোন সিদ্বান্ত ছাড়াই শেষ হয় । ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রমরমা ব্যবসা আরো বেগবান হয়েছে । ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদী আরব থেকে সরাসরি ইসরাইল গমন করেন । পরে ফিলিস্তিন ও জর্ডানের শাসকদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন । ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্য সফরের পর পরই এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় । সফরের যোগ বিয়োগ কষতে থাকে রাজনৈতিক মহল । মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশ সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও সিরিয়ার বিরুদ্বে স্বোচ্চার ছিল । বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আকার ইঙ্গিতে সৌদী আরবের প্রশংসা করেন । মজার ব্যাপার হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি শব্দও উচ্চারন করেননি । অথচ উত্তর কোরিয়া ওয়াশিংটনের প্রতি বৃদ্বাঙ্গুল প্রদর্শন এবং মার্কিন মিত্র জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে আসছে । অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর উপলক্ষে সৌদী সরকার নিজের প্রভাব প্রদর্শনের জন্য আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনের আয়োজন করে । যার গুরুত্বপূর্ণ অতিথি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ।

 

প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনের উদ্দেশ্য কি ? উক্ত সম্মেলনের মধ্যমনি ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ইরানের বিরুদ্বে বিষেদাগারের উদ্দেশ্য কি ? দেশটিতে বিপূল সমরাস্ত্র মজুত থাকা সত্বেও হঠাৎ করে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রক্রয় চুক্তির রহস্য কোথায় ? উপরের তিনটি প্রশ্ন বিশ্লেষন করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে । বিশ্বে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখে সন্ত্রাস বিরোধী বক্তব্য কখনো শোভনীয় নয় । সামরিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়াকে দোজখে পরিণত করেছে ওয়াশিংটন । আইএসএর মদদদাতা হিসেবে ওয়াশিংটনের নাম সর্বজনবিদিত । সিরিয়া ও ইয়েমেনে ওয়াশিংটনের প্রত্যক্ষ মদদে গৃহযুদ্ব চলছে । ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস প্রায় কোনঠাসা । কিন্তু ওয়াশিংটন আইএসকে সমর্থন যোগাতে এদু’টি দেশে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে । রাশিয়া, চীন ও ইরান যখন সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে লিপ্ত ঠিক তখন ওয়াশিংটন মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে বিভেদ উস্কে দিচ্ছে । তারই ধারাবাহিকতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন । কথিত মুসলিম সামরিক জোটে অতিরিক্ত ৩৪ হাজার সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে সিরিয়ার গৃহযুদ্বকে উস্কে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হচ্ছে । উক্ত সামরিক জোটকে এক সময় ইরানের বিরুদ্বে ব্যবহার করা হলে মুসলিম বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে ।

 

ইরান ও সিরিয়া ইস্যু সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিন জাতির ভবিষ্যতে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে । তুরস্ক, মিশর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সূ-সম্পর্ক বিরাজ করছে । ফলে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে অগ্রসর হবার অবশিষ্ট কেউ থাকবেনা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে মুসলিম বিশ্ব ক্ষতবিক্ষত । বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে গৃহযুদ্ব, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।  এসব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের ফসল । সূতরাং যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের মদদদাতা তারা মুসলিম দেশের বন্ধু হয় কিভাবে ? রাজতন্ত্র, ভোগবিলাস ও অপচয়কারী রাজা বাদশা শাসিত উপসাগরীয় দেশগুলো যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায় । এবিষয়ে তাদের কোন বাছ বিচার নেই বললেই চলে।  তাই ওয়াশিংটন ও তেলআবিবকে খুশী রাখতে তারা রাজস্ব ভান্ডার খুলে রেখেছে । আগেও কয়েকটি লিখায় উল্লেখ করেছিলাম – উপসাগরীয় রাজ বাদশারা ইরান, সিরিয়া লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের আনছারুল্লাহকে প্রধান শত্রু হিসেবে গন্য করে আসছে । অপরদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের সুবাদে সৌদী রাজতান্ত্রিক সরকার মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে তৎপর রয়েছে । যার ধারাবাহিকতায় সৌদী উদ্যোগে মুসলিম সামরিক জোটের আত্নপ্রকাশ এবং রিয়াদে আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলন ।

 

সৌদী নেতৃত্বে মুসলিম সামরিক জোট বহাল থাকলে এক সময় উক্ত জোটকে সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানের বিরুদ্বে ব্যবহার করার সম্ভবনা রয়েছে । এমন ঝুঁকিপূর্ণ উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে সৌদী সরকার সন্মুখে অগ্রসর হচ্ছে । ১১ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে ক্রয়কৃত সমরাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম সামরিক জোটকে প্রদান করা হবে । এতে সামরিক জোট শক্তিশালী হিসেবে গড়ে উঠার পাশাপাশি সৌদী নেতৃত্বে সিরিয়া, ইরান ও ইয়েমেনে যুদ্বে জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে । রাশিয়া ও চীনের দাপট এবং উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে পিছু হটার পাশাপাশি ওয়াশিংটন মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে । ইরান, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন ইস্যুতে রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থ জড়িত রয়েছে । কিন্তু সৌদী নেতৃত্বে মুসলিম সামরিক জোট সিরিয়া কিংবা ইরানে হস্তক্ষেপ করলে রাশিয়া ও চীন নীরব থাকবেনা । তখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে । যদ্বে কোন পক্ষ জয়ী না হলেও সৌদী সরকারকে এজন্য চড়া মূল্য দিতে হবে । সৌদী রাজ পরিবারকে একটি আতঙ্ক সব সময় তাড়া করছে । সেটা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান একক পরাশক্তি হলে সৌদী রাজতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে । ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদী আরব সফর, ৩৮ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি, আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলন, মুসলিম সামরিক জোট এবং ইরানের বিরুদ্বে বিষেদাগার একই সূতোয় গাঁথা ।

 

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *