ঢাকা : সত্য আর সুন্দরের আবাহনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। আজ শুক্রবার সকাল ৯টায় চারুকলার সামনে থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর…।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ হাজারো বাঙালি।
মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরুতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামানা নূর বলেন, ‘বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব নববর্ষ। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এই বর্ণিল আয়োজন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে কোনও গোষ্ঠীর হুমকিতে বাঙালিরা দমে যাবে না। উৎসবের রঙে রঙিন হয়েছে বাংলা নববর্ষ বরণের এই আয়োজন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন বলেন, ‘সকল অমঙ্গলকে দূর করে শুরু হচ্ছে আরেকটি নতুন বছর। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী।’
এরই মধ্যে ইউনেস্কো বর্ষবরণের এ শোভাযাত্রাকে বিশ্বসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর এই প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে নববর্ষের এ শোভাযাত্রা। এ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদ গত ২৮ বছরের উল্লেখযোগ্য মোটিফগুলো এবারের শোভাযাত্রায় সন্নিবেশিত করা হয়।
এবারের শোভাযাত্রায় মোটিভগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের দ্বৈত সত্তাকে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে থাকবে অনেকগুলো সূর্যের মুখের কাঠামো, যার একপাশে থাকবে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত মুখ। আর অন্যদিকে থাকবে সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার কদাকার মুখ। মানুষের অন্তনির্হিত এই দুই রূপ কাঠামোয় তুলে ধরা হয় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ আর বিশাল আকৃতির সব বাহন নিয়ে এ শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে বের হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা) হোটেল চত্বর ঘুরে টিএসসি প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলার সামনে এসে শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এ বর্ণিল আয়োজনটি রঙে-ঢঙে পায় ভিন্ন এক মাত্রা। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতির জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের বিষয়। পাশাপাশি দেশে রয়েছে উগ্রবাদীদের চোখ রাঙানি। তাই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন হচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় শোভা পায় সর্বমোট ১২টি শিল্প কাঠামো। মূল শিল্প কাঠামোটি হয়েছে ২৫ ফুট উচ্চতার সূর্যের মুখ। যার একপ্রান্তে আছে হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী আর অন্যদিকেসূর্যের বিপরীতে বীভৎস কদাকার মুখ। শুভ ও অশুভ মানুষের অন্তনির্হিত এই দুই রূপ তুলে ধরা হয়েছে। সে সঙ্গে ছোট ছোট আরো ১৬টি হাস্যোজ্জ্বল সূর্য মুখ।
এবার শোভাযাত্রা আবার ফিরে এসেছে সমুদ্রবিজয়ের স্মারক হিসেবে তৈরি করা ময়ূরপঙ্খী নাও। এই শিল্প-কাঠামোটির উচ্চতা ২৫ ফুট। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঠাঁই পাওয়া হাতি, ঘোড়া, বাঘ ও টেপা পুতুলও স্বরূপে ফিরেছে এবারের আয়োজনে। এ ছাড়া বিশাল কদাকার মুখের এক দানবের শিল্প কাঠামোও নির্মিত হয়েছে, যা দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কুৎসিত মুখটি আবারো তুলে ধরা হয়েছে জাতির সামনে। এ ছাড়া শোভাযাত্রায় শোভা পেয়েছে রাজা-রানির মুখোশসহ নানা অনুষঙ্গ।
এ বছর প্রথমবারের মতো দেশের ৩০ হাজার সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ থেকে বের হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই শোভাযাত্রা বের করার নির্দেশ দিয়েছে।
এ ছাড়া বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও সকল উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ইউনেস্কো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।