মো. আফজাল হােসেন, দিনাজপুর প্রতিনিধি :
ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় আবাদী জমি ও বনাঞ্চল বিনষ্ট করে বসতবাড়ী নির্মাণ করায় এ উপজেলায় কৃষিখাত কর্মসংস্থানের সুযোগ দিনদিন কমে আসছে। কি আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির প্রসারে ঘটার সাথে সাথে পার্বতীপুর উপজেলায় স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে গবাদিপশু ও হাস-মুরগি পালন ক্রমই জনপ্রিয় হয় উঠেছে। এত গবাদিপশু পালন আত্ম-কর্মসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষত্র পরিনত হয়েছে। উপজেলায় গড় উঠেছ পারিবারিক ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক পর্যায় হাস-মুরগি ও গবাদিপশুর নতুন নতুন খামার। আর এসব খামার কে কেন্দ্র করে উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পশু খাদ্য, পশু চিকিৎসা, দুধ, ডিম ও মুরগির অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেক বেকার যুবক গবাদিপশুর চিকিৎসায় যুক্ত হয়ে স্বচ্ছল জীবন-যাপন পথ খুজে পেয়েছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সুত্র জানা গেছে, কৃষি নির্ভর পার্বতীপুর উপজেলায় বর্তমান বাণিজ্যিকভাবে শতাধিক দুগ্ধ খামার, ২৪টি ছাগলের খামার, ২৬টি ভেড়া খামার, ১২২টি মুরগির খামার, ৪৮টি হাসের খামার ও ১টি বড় আকৃতির কােয়েল খামার গড়ে উঠেছে। এছাড়া পারিবারিক পর্যায়ে দুটি-তিনটি গরু নিয় অসংখ্য ছোট-খাটো দুগ্ধ খামার প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও প্রতিটি পরিবার দেখতে পাওয়া যায়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলে প্রতিটি বাড়ীতে রয়েছে ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী অসংখ্য হাস-মুরগি। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে এখান থেকে প্রতিদিন অসংখ্য গরু, ছাগল, হাস-মুরগি, দুধ, ডিম ট্রাক ও কোচ করে ঢাকাসহ দেশর অন্যান্য জেলায় রপ্তানী হচ্ছে। গত বছর কােরবানীর ঈদ এলাকার চাহিদা মিটিয় প্রায় ৪৮ হাজার গরু-ছাগল, ভেড়া দেশের বিভিন অঞ্চল সরবরাহ করেন গবাদিপশু ব্যবসায়ীরা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সহকারী খলিলুর রহমান দাবী করেন, পার্বতীপুর কয়লা ও পাথরের খনি আছে, শুধু তাই নয় এখানে ডিমের খনি আছে। তিনি জানান, উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের মধ্যপাড়ায় রয়েছে পাথর খনির পাশ সিপি বাংলাদেশ নামে একটি লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদিত প্রায় ৮০ হাজার ডিম প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সরবরাহ দেয়া হয়।
প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ ইদ্রিস আলী বলেন, এক সময় পার্বতীপুর একটি দেশী গাভী থেকে প্রতিদিন মাত্র ২ লিটার দুধ পাওয়া যেত। কি দেশী গাভীকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যম উন্নতজাতের গাভী সহজলভ্য হওয়ায় বর্তমান একেকটি গাভী থেকে দিনে প্রায় ২৫-৩০ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। দুধ, ডিম ও মাংসের দাম বেশ চড়া হওয়ায় হাস-মুরগি গবাদিপশু পালন লাভজনক পেশায় পরিনত হয়েছে।
উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের দােড়ারপাড় গ্রামের বিত্তহীন সাইফুল ইসলাম (৪০) গত ৪ বছর ধর হাসঁ পালন কর অনক আর্থিক উনতি করছন। তিনি প্রতি বছর এপ্রিল মাসর প্রথম সপ্তাহ গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা থেকে দেড় থেকে দুই হাজার ১দিন বয়সের হাসেঁর বাচ্চা কিনে নিয়ে আসেন। উপজেলা পশুসম্পদ অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে এসব হাসেঁর খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিন মাস খাবারের উপযােগি হলে সে গুলো বিক্রি করে দেন। এতে খরচ বাদে প্রতি বছর তার প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়।
শহরের রােস্তম নগর মহল্লার আসমাউল হুসনা বলেন, তার ২০টি উন্নতজাতের ছাগল রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে পিপিআর এর টিকা এনে তিনি নিয়মিত টিকা দেন। এতে তার কােন ছাগল মারা যায় না। ছাগল পালনের মাধ্যম তার সংসার স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী গরু থেকে বর্তমান তার ১৫টি উন্নতজাতের গরু রয়েছে। এর মধ্য উন্নত জাতের ৯ গাভী, ৬টি বাছুর রয়েছে। প্রতিদিন দুধ উৎপাদিত হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ লিটার। আর এসব থেকে বছর প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা লাভ আসে। এদিকে, পারিবারিক ও খামার পর্যায়ে গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধির ফল উপজেলার কৃষকরা অন্য সময়ের চেয়ে বর্তমান খড়ের ভালো দাম পাচ্ছেন। শুধু খড় গবাধিপশুর খাদ্য চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ফিডের ব্যবসা বাড়ছে, সবুজ ঘাষের চাষাবাদ। ৫-৬ বছর আগ উন্নত নেপিয়ার জাতের ঘাসের চাষাবাদ তেমন ছিল না বললে চলে। বর্তমান বাণিজ্যিকভাবে ঘাষের চাষে হচ্ছে। এবছর পার্বতীপুর উজেলায় ১৬০ জন কৃষক প্রায় ১০০ একর জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করছেন। উপজেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর আটরাই গ্রামের আঃ সামাদ আলী (৪০) ১ একর ২০ শতক জমিতে ঘাস চাষ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেছেন ও ঘুচিয়েছেন বেকারত্ব। ফিরে এসেছে পরিবার স্বছলতা। এখন ঘুম থেকে উঠেই দেখা যায় শহর ও গ্রামের রাস্তার মােড়, হাট বাজার পিক-আপ বা রিক্সা-ভ্যান করে ঘাস বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ ইদ্রিস আলী জানান, পার্বতীপুর পৌর সভা ও ১০টি ইউনিয়ন ১ লাখ ৬৫ হাজার গবাদিপশু, এর মধ্যে ৪৭ হাজার ৭৬০টা উন্নত জাতের গাভী, ৮৩ হাজার ছাগল, ৬৩ হাজার ভেড়া, প্রায় ৪ লাখ মুরগী ও ৩ লাখ ৮২ হাজার হাসসহ আরো অনেক পশুপাখি। এসব গবাদিপশু চিকিৎসা, কৃত্রিম প্রজনন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদানের কাজ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করে থাকে। তবে লোকবলের সংকট থাকায় চাষীদের চাহিদা সবসময় পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন বে-সরকারী সংস্থার উপজেলার পশুসম্পদ উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, খামারীদের ঋণ সুবিধা প্রদান করলে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র বিমোচন গবাদিপশু পালন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। কি অতীতে প্রদত্ত ঋণের টাকা অনাদায়ী থাকায় নতুন করে ঋণ প্রদানের সম্ভাবনা কম। তিনি দাবী করেন বিগত ২০ বছর যারা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিলেন এসময় তাদের ঋণ আদায়ের সাফল্য শতকরা ৩১ ভাগ। পন দু’বছর আগ পার্বতীপুর যাগদানর পর তিনি এই সময় বকেয়া ঋণ আদায় শতকরা ১৮ % ভাগ সাফল্য অর্জন করেছেন। ২০১৩-১৪ সাল কৃত্রিম প্রজননের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬হাজার ৪২০। অর্জন হয়েছে ৪ হাজার ৮২০। ২০১৪-১৫ সাল কত্রিম প্রজননের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫হাজার ৬০০। অর্জন হয়েছে ৫ হাজার ৪৯৫। ২০১৫-১৬ সাল কত্রিম প্রজননের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৪৫০। অর্জন হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৩। চলতি অর্থ বছর ২০১৬-১৭ সালের কৃত্রিম প্রজননের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৬০০। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৫হাজার ১৮২।