‘মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছি, কিভাবে স্কুলে যাবো

 

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি |

‘আমি তো আসামি। স্কুলে যাব না, পড়ালেখা করবো না। স্কুলে গেলেই তো সবাই আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে। আমার সঙ্গে কেউ বসতেও চাইবে না। মিথ্যা হত্যার মামলায় জেল খেটেছি, কেউ তো এ কথা বুঝবে না। সমাজে লজ্জায় আমি মুখ দেখাতে পারবো না।’

কান্নায় ভেঙে পড়ে কথাগুলো বলছিল স্থানীয় হাজি জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বুশরা আক্তার পান্না। সে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কমলপুর মুসলিমের মোড় এলাকার রিকশাচালক মো. খায়ের মিয়ার ছোট মেয়ে।

ভৈরব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজমুল হুদার রোষাণলে পড়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ও একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ৩৫ দিন কারাভোগের পর গত বৃহস্পতিবার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায় পান্না। একই মামলায় তার সঙ্গে কারাভোগ করেন তার বড় বোন দুই সন্তানের মা বন্যা বেগমও। কারাভোগের পর বাড়িতে এসেও তারা লোকলজ্জার ভয়ে প্রায় অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছেন।

এলাকার আলোচিত ঘটনা হওয়ায় প্রতিদিন প্রতিবেশীরা ছুটে আসছে ওই দুই বোনকে দেখতে। তাই বর্তমানে নিজ বাড়িতে বন্দিজীবনই কাটাতে হচ্ছে দুই বোনকে। মিথ্যা ঘটনা স্বাভাবিক জীবনে বাধা তৈরি করায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের বিচারসহ ওই মামলা থেকে মুক্তি চায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই বোনসহ তাদের পরিবার।

খায়ের মিয়া ও তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম বীনা জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে একটি ডাকাতি মামলায় অভিযুক্ত আসামি তাদের ছেলে কাউছারকে (২৫) গ্রেফতার করতে এসআই নজমুল হুদার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাদের বাড়িতে আসে। পুলিশ সদস্যরা হঠাৎ করে তাদের বাড়ির ফটকের গেট ভেঙে ঢুকে পড়ে।

তখন ঘরে থাকা দুই বোন পান্না ও বন্যা এগিয়ে গিয়ে বাড়ির গেট ভেঙে পুলিশ প্রবেশ করায় প্রতিবাদ করেন। এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে এসআই নাজমুল হুদা দুই বোনকে কিল-থাপ্পড় মারেন ও লাঠি দিয়ে পেটান এবং ঘরে ঢুকে কাউছারের খোঁজ করেন।

পরিবারের অভিযোগ, এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাদের ঘরের আসবাবপত্র ও মালামাল তছনছ করতে থাকলে দুই বোন আবারও প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে কাউছারকে না পেয়ে দুই বোনকে আবারও মারধর করে থানায় নিয়ে যান এসআই নাজমুল। সেখানে নিয়েও দুই বোনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পুলিশ।

পরে দুই বোন বন্যা-পান্নাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন ঘটনায় জাগো নিউজে খবর প্রকাশ হলে চাপের মুখে পড়ে পুলিশ বিভাগ। এ ঘটনায় ওই এসআইকে গাজীপুরে বদলি করা হলেও শাস্তি হয়নি তার।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামির ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় ভৈরব থানার সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসে থাকা এক যাত্রী পিকেটারদের ইট-পাটকেলে আহত হন। ওই বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

ওই ঘটনায় পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ভৈরব থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। গ্রেফতারের পর এদিনই ওই মামলায় অভিযুক্ত আসামি দেখিয়ে দুই বোনকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরে আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান।

রোববার সকালে এই প্রতিনিধি তাদের বাসায় গেলে পান্নার বোন বন্যা জানান, জেলে যাওয়ার পর তার দুই শিশু সন্তানকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাবার বাড়ি থেকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। ৩৫ দিন কারাগারে বন্দি থাকায় তার দুই শিশু মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

তিনি বলেন, জেল খেটেছি বলে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে দেখতে আসেনি এবং আমার শিশু সন্তান এখনো ফেরত দেননি। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে এখন আমি অপরাধী, তাই দুটি কোলের শিশু আমার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, জীবনে এমন অপমান আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার আর কখনো হননি। থানায় নির্যাতনের পর ওই এসআই আমাদের দুই বোনকে হুমকি দিয়ে বলেছিল ‘মাইরের কথা কাউকে বললে, তোদের আবারও জেল থেকে থানায় আনা হবে।’

বিনা অপরাধে জীবনকে কলঙ্কিত করায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা নজমুল হুদার বিচার দাবি করেন তিনি।

রিকশাচালক বাবা খায়ের মিয়া জানান, আমার দুই মেয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছে কিন্তু মিথ্যা মামলা থেকে এখনো মুক্তি পায়নি। অভিযুক্ত ওই পুলিশের বিচারসহ আমার মেয়েদের মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *