বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক খোন্দকার মোজাম্মেল হক ইন্তেকাল করেছেন ২৯ জুন ২০২০। তার অকাল এই মৃত্যু পরিবার-পরিজন ছাড়াও অসংখ্য মানুষকে করেছে ব্যথিত। শোকাহত এই মানুষদের মধ্যে আমি অধমও আছি। সঙ্গত কারণেই। তাঁর প্রতি পরম শ্রোদ্ধা জানিয়ে ফেইসবুকে স্মৃতিচারণ করেছি। শিরোনাম ছিলো, “ মোজাম্মেল ভাই চলে যাওয়া মানে, উদার এক বটবৃক্ষের তিরোধান।” মোজাম্মেল ভাইকে নিয়ে আমার স্মৃতি চারণ ভয়েসবাংলা আপ করেছে। শিরোনাম ছিলো, “ক্ষমা করে দিয়েন মোজাম্মেল ভাই।” আমার দৈনিক দখিনের সময়-এ বেদনাদায়ক এ খবরটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছি।
এর অর্থ এই নয় যে, আমি খুব কামেল ব্যক্তি! সাংবাদিক ও মানুষ হিসেবে মোজাম্মেল ভাইর যে নেতৃত্ব গুণ, বৈশিষ্ট এবং উদারতার পরশ পেয়েছি তা খানিকটা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা। এছাড়া মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান জানানো আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। মৃতব্যক্তির সকল দোষ-ত্রুটিই ঐতিহ্যগত কারণে আমরা আড়ালেই রাখি।
এটাই কাংখিত ও স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক এই ঘটনাকে ‘ঘেটে ঘ’ করে দিলেন আমার স্নেহের খোন্দকার বেলায়েত হোসেন, সম্ভবত তিনি মোজাম্মেল ভাইর আত্মীয়। মরহুমের পত্রিকার বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার। আমরা যখন মোজাম্মেল ভাইর নেতৃত্বে সাপ্তাহিক সুগন্ধা নিয়ে রাত-দিনের ব্যবধান ঘুঁচিয়ে লড়েছি তখন তিনি সাপ্তাহিক সুগন্ধার নিবেদিত প্রাণ সার্কুলেশন বিভাগে ছিলেন। খুবই স্বজ্জন, বিনয়ী ও কাজের মানুষ। কিন্তু একটি অকাজের ঘটনা সে ঘটিয়ে বসলেন ৬ জুলাই, তার ফেইসবুক পোস্টে।
ইনন্ডিপেনন্ডেন্ট টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত গেদুচাচার খোলাচিঠির লোগোকে নকল বলে মন্তব্য করে বসলেন। অতি শোকাহত মানুষ তো কতকিছুই করে! এই বাস্তবতায়ই হয়তো গেদুচাচা নিয়ে সত্যের অপলাপ করার মতো কান্ড করে বসলেন খোন্দকার বেলায়েত হোসেন। তবে এটি দ্বিতীয় বার। প্রথমবার করেছিলেন মোজাম্মেল ভাই, ১৯৮৯ সালে।
পাওয়ার সেক্টরের সে সময়ের প্রধান ব্যবসায়ী, পরে পূবালী ব্যাংক এবং একাধিক ইনন্সুরেন্স’র উদ্যোক্তা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন একটি পত্রিকা বের করলেন। তাঁর এলাকা ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীর নামে পত্রিকার নাম, সাপ্তাহিক সুগন্ধা। ইত্তেফাকের সেই সময়ের চিফ রিপোর্টার বরিশালের খায়রুল আনামকে পত্রিকার দায়িত্ব দিলেন। তার নেতৃত্বে এক বছর সুগন্ধা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পত্রিকাটি মরা গাঙ্গই থেকেগেছে। সুগন্ধা নদীর অবস্থা যেমন। ঝানু ব্যবসায়ী সৈয়দ মোয়াজ্জেম বুঝলেন, হবে না! তিনি বিকল্প ভাবনা শুরু করলেন। কিন্তু কোন কুল-কিনার পাচ্ছিলেন না। এ সময় পত্রিকার হকার কাশেম খবর দিলেন মোজাম্মেল ভাইর।
মোজাম্মেল ভাই তত দিনে সাপ্তাহিক রিপোর্টার ছেড়ে দিয়েছেন। অথবা পত্রিকাটি বন্ধ হয়েগেছে। সম্ভবত এরশাদ মজুমদার পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর পরিবর্তে তারই মালিকানার আর একটি পত্রিকা সাপ্তাহিক ফসল পুনরায় প্রকাশ করতে শুরু করেন, ফকিরাপুলের পুরনো অফিস থেকেই। পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন শফিকুল আজিজ মুকুল। সাপ্তাহিক রিপোর্টার সূত্রে আমি সাপ্তাহিক ফসলেও কাজ করছিলাম। পরে এই সূত্রেই দৈনিক বাংলার বাণীতে গিয়েছিলাম। তখন, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী সিনিয়র রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদের রোষাণলে আমার অবস্থা ঝড়ে পড়া কাকের মতো।
এরপরও বাংলার বাণীতে নিতে মোটেই কুন্ঠা বোধ করেননি মুকুল ভাই। বিষয়টি তাকে মনে করিয়ে দেয়ায় বলেছিলেন, “রাখো! আমি পত্রিকা চালাতে নেমেছি। রাজনীতি না।” যদিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিরই লোক ছিলেন মুকুল ভাই। লেখাপড়া জানা লোক তিনি, ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনির খুবই ঘনিষ্ঠজন। পত্রিকা নিয়ে কাতলা মাছের মতো খাবি খাবার অবস্থায় শেখ সেলিম বাংলারবাণীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুকুল ভাইকে, নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। সে অন্য প্রসঙ্গ। আজকের প্রসঙ্গ সুগন্ধা ও গেদুচাচা।
একদিন দুপুরে ইকবাল কবির ফকিরাপুলের সাপ্তাহিক ফসল অফিসে আসলেন। ফিস ফিস করে বললেন, “ওস্তাদে দেখা করবার বলছে।” ওস্তাদ কে, তা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি। আমাদের কাছে তখন ওস্তাদ মানে, একমাত্র মোজাম্মেল ভাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
:মতিঝিল শরীফ ম্যানশনে, প্রিন্স কর্পোরেশন।
: ঠিক আছে।
ইকবাল কবির চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, “বিকেলে আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।” হয়তো সে আমার যাওয়ার বিষয়টি একশ’ ভাগ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। অথবা এটি তাঁকে করতে বলা হয়েছিলো। আমি ঠিক জানি না।
শেষ বিকেলে ইকবাল কবির এলেন। তার সঙ্গে গেলাম শরীফ ম্যানশনে। তিন তলায়। প্রথমেই নজর পড়লো মোজাম্মেল ভাইর সেই হাসি মুখ। তবে অধিক উজ্জ্বল। তাঁর সামনে অতি মলিন অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক টেবিল ঘিরে বসা খুরশিদ আলম, রানা আশরাফ, ইকবাল হোসেন শানু এবং আরো কয়েকজন। সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। মোজাম্মেল ভাই বললেন, “আসেন আলম রায়হান মিটিং শুরু করি।” বুঝলাম ইকবাল কবির আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসার শানে নুযূল।
মোজাম্মেল ভাই সংক্ষেপে সুগন্ধা ও সুগন্ধা মালিকের ইতিহাস বললেন। সিনেমার প্রমোর মতো। এর পর সবার কথা শুনলেন একেএকে। তার বলার দক্ষতা যেমন ছিলো, তেমনই শোনার ধৈর্যও ছিলো অসাধারণ। সবার কথা শোনার পর আমাকে বললেন, আলম রায়হান, আপনি বলেন।
: মোজাম্মেল ভাই, বলার কিছু নেই। আপনি যেভাবে চিন্তা করেছেন আমরা সেভাবে এ্যাক্ট করবো।
: পত্রিকার সাইজ কী হলে ভালো হয়?
: অবশ্যই বর্তমান আদম সাইজ না।
: এক বছর ধরে তো এই ডাবল ডিমাই সাইজে চলেছে।
: কোন লাভ হয়নি। পাঠক রিসিভ করে নাই। এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে মাত্র ছয় কপি!
: তা হলে..?
:ম্যাগাজিন সাইজ করেন। ম্যাগাজিন সাইজ ছাড়া পাঠক ধরানো কঠিন হবে। আর করতে হবে সাপ্তাহিক রিপোর্টারের মতো, লো বাজেটে। খরচ বেশি হলে মালিক ব্যাক গিয়ার মারতে পারে। এমনিতেই তাঁর এক বছরের বিনিয়োগ জলে গেছে! ব্যবসায়ী মানুষ, বেশি লসের পথে হাটতে চাইবেন না। আমাদের রিক্স নিয়ে কী দরকার!
একই মিটিং-এ আলোচনা হলো, পত্রিকাকে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট দেবার বিষয় নিয়েও। মোজাম্মেল ভাই বললেন, এরশাদ ভাই তো মায়ের চিঠি লিখতেন। আমরা কি বাবার চিঠি লিখবো? কি ভেবেই যেনো বললাম, বরং চাচার চিঠি হলে ভালো হয়।
: ভালো বলেছেন! এরশাদ ভাইর চিঠিতো মা ছেলেকে বড় মিয়া বলে সম্মোধন করতেন। তা হলে আমরা কী বড় চাচার চিঠি বলবো?
: এরশাদ ভাইর ধারা কপি করা ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, গেদুচাচার চিঠি হলে ভালো হয়। বরিশালের বাচ্চাদের আদর করে গেদু বলে ডাকে। ছোট চাচাকেও গেদুচাচা বলে অনেক এলাকায়। লেখায় থাকবে নোয়াখালির ভাষার মিশ্রণ। এভাবে ফানের আড়ালে কঠিন কথা বলা যাবে।
চিঠি লেখার দায়িত্ব দেয়া হলো খুরশিদ আলমকে। কিন্তু সে অশ্বস্তি প্রকাশ করলো। তার কাছে বিষয়টি ‘ছ্যাবলামো’ মনে হতো। আমাকে বিষয়টি বললো। আমি বলাম, আরে ভাই, কিছু দিন করেন; পরে ভালো লাগবে। সম্ভবত সে বিষয়টি পরে মোজাম্মেল ভাইকেও বলেছেন। একদিন মোজাম্মেল ভাই বললেন, খুরশিদ তো লিখতে চায় না!
: তাইলে বাদ দেবেন?
: আরে না! আপনে লেখেন।
: মোজাম্মেল ভাই, আমিতো বরিশালের, নোয়াখালি তো পুরা আসবে না।
: পুরা আসার দরকার কি! ককটেল করবেন।
ককটেল শব্দটি তখন আমাদের কাছে খুবই মনোহর! আর ইউনিভার্সিটির হলে বরিশালের গ্রুপের মধ্যে মধ্যমনি ছিলো নোয়াখালীর খোকন। মাহফুজুর রহমান, পেশাগত জীবনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাটে চাকুরী করা ধনবান দুলাভাইর প্রিয় শ্যালক। তিনি আমাদের হলেও গেছেন দুএকবার।
খোকনকে খ্যাপানোর জন্য নোয়াখালীর ভাষা অনুশীলন করতাম। কাজেই লিখতে খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয়। হয়ওনি। তবে আমারও এক রকমের অস্বস্তি হচ্ছিলো খুরশিদ আলমের মতো। কোন অবস্থাতেই একে সাংবাদিকতা হিসেবে মেনে নিতে পারছিলাম না।
ফলে চিঠির নিচে নাম দেয়া শুরু হলো স.ম.হ। মানে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। যদিও এ ধরনের বিষয়ে এক লাইন লেখার ক্ষমতা তাঁর ছিলো না। তিনি ছিলেন পত্রিকার মালিক, আগেই উল্লেখ্য করেছি। মাঝে মধ্যে মোজাম্মেল ভাইও লিখতেন। প্রথম দিকে তিনিও বিষয়টিকে গ্রহণ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে আমাদের সকলের কাছে পরিস্কার হলো, লো-বাজেটের সাপ্তাহিক সুগন্ধার প্রাণভোমরা আসলে গেদুচাচার খোলাচিঠি।
বছর না ঘুরতেই সুগন্ধার প্রচার সংখ্যা পিকে গেলো। আর, এক বছরের মধ্যেই দলবল নিয়ে মোজাম্মেল ভাই হঠাৎ একদিন চলে গেলেন সুগন্ধা ছেড়ে। এর আগে আমাকে একদিন বললেন, “আলম রায়হান বেশি দিন এখানে থাকা যাবে না, পরের ছেলে লালন-পালন করে কী লাভ!”
: আমরা না থাকলে, মোয়াজ্জেম সাহেবকে বলেন।
: পাগল! হঠাৎ সবাই চলে যেতে হবে।
: মোজাম্মেল ভাই, এটা ঠিক হবে না। একটা লোক ভরসা করলো, না বলে চলে যাবো!
মোজাম্মেল ভাই কিছু বললেন না। কেবল তার একটু চেহারা কঠিন হলো। এই প্রথম তার ক্ষুব্ধ চেহারা দেখলাম। তবে কয়েক মুহুর্ত মাত্র। পরে একটু হেসে বললেন, আচ্ছা দেখি। পরদিন মোজাম্মেল ভাই আমাকে বললেন, “মালিক চায় না আপনি সুগন্ধায় কন্টিনিউ করেন।”
আমি ঠিকই বুঝেছিলাম, আসলে কে কি চায়, আর চায় না। আমি এ নিয়ে কোন কথা বলিনি। দেখা করিনি মোয়াজ্জেম সাহেবের সঙ্গেও। আমার বিবেচনায় ছিলো, মোজাম্মেল ভাইর কারণেই আমি সুগন্ধায়। প্রথম দিন থেকেই তিনি আমাকে চীফ রিপোর্টার করেছেন। বেতন তিন হাজার থেকে দ্রুত বাড়িয়ে করেছেন সাত হাজার টাকা। এসব কৃতজ্ঞতায় কৃতদাসের মতো মোজাম্মেল ভাইর কথা মেনে সোজা গোড়ানের বাসায় চলে গেলাম। তখন আমার বিবাহিত জীবনের হানিমুন প্রিরিয়ড।
শেষ বিকেলে আমাকে বাসায় দেখে নববধু আল্লাদে বাকবাকুম! কিন্তু সে টের পায়নি, বজ্রপাত হয়েছে ‘নি:শ্বব্দে’। আমি চাকুরী চ্যূত। এদিকে সৈয়দ মোয়াজ্জেম ঠিকই টের পাচ্ছিলেন। পত্রিকা ছাপার আগের দিন অফিস করে গমগম, সবাই থাকে মহাব্যস্ততা। কিন্তু সেদিন অফিস ছিলো ফাঁকা, শুনশান নীরবতা। কেউ কোথাও নেই! সৈয়দ মোয়াজ্জেম মিলনকে বললেন, “বরিশাইল্যাডাও গেছে?” মিলন বললো, “আলম স্যারকে তো মোজাম্মেল স্যার চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে।”
: কও কী? বাসায় যা, তারে নিয়া আয়।
মিলন আমার বাসায় আসলো। অনেকটা বগলদাবা করে সুগন্ধা অফিসে নিয়ে গেলো। মোয়াজ্জেম সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আলম রায়হান, পত্রিকা আপনার, আপনি চালান। আমি কিছু জানি না।” তাঁর কথা শুনতে ভালো লাগলো, তবে বিশ্বাস করিনি। আগে থেকেই জানাছিলো, মালিকরা ঠেকলে কুকুরকেও ঠাকুর বলে! ফলে তার বায়বীয় কথা নিয়ে আমি মোটেই ভাবিনি।
আমার ভাবনা হলো অন্য বিষয় নিয়ে। পর দিনই ছিলো পত্রিকা বাজারে দেবার নির্ধারিত সময়। কিন্তু অফিসে কোন ম্যাটার নেই। সব আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গেলাম কাছেই কম্পিউটার অফিসে। সেখান থেকে অনপেমেন্টে কম্পোজ করানো হতো। কিন্তু সেখানে অন্য এক নাটক। আমার স্নেহের এক ছোট ভাই দাঁড়ালো পাহাড় সমান বাঁধা হয়ে। সে কিছুতেই ম্যাটারের প্রিন্ট নিতে দেবে না।
এক পর্যায়ে সেভেন আপের বোতল ভেঙ্গে রণমূর্তি ধারণ করলো। কিন্তু সে তো আর জানে না, ৭৪ সাল থেকেই আমি নানান ধরনের “যন্ত্র” দেখে অভ্যস্ত, বিভ্রান্ত রাজনীতির কারণে। এক পর্যায়ে আমার ছোট ভাইটি বুঝলো, তার হুংকারে কোন কাজ হচ্ছে না। রণে ভঙ্গ দিলো। এছাড়া কম্পিউটারের মালিক খুবই সহযোগিতা করেছিলেন। ইকবাল কবীর এবং ইকবাল কবীর শানু যে অকা¬ন্ত পরিশ্রম করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
নানান জোড়াতালি দিয়ে নির্ধারিত দিনের একদিন পর সাপ্তাহিক সুগন্ধা বাজারে দিতে পেরে আমরা এক ধরনের শ্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু শুরু হলো অন্য অশ্বস্তি।
চুক্তিতে নেয়া গোলাম মোহাম্মদ চাষীর মালিকানার সাপ্তাহিক সূর্যোদয়-এ মোজাম্মেল ভাই দাবী করতে শুরু করলেন, গেদুচাচার চিঠি তার। কিন্তু তার এই দাবী হালে পানি পাচ্ছিলো না। এ অবস্থায় তিনি উকিল নোটিশ করলেন। এ নোটিশ পুরোটা সাপ্তাহিক সূর্যোদয়ে ছেপে দিলেন। কিন্তু পাঠক বিভ্রান্ত করতে পারেননি। এ অবস্থায় তিনি আদালতে মামলা করলেন। চাইলেন নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত তা দেননি। বরং কয়েক তারিখের পর মামলাটি খারিজ করে দিলেন আদালত।
ততদিনে মাসুদ কামাল, শহীদুল আজম, জহিরুল আলম, শওকত আলী সাগর ও মোস্তফা কামাল সাপ্তাহিক সুগন্ধায় যোগদান করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হলো একদল তরুন সাংবাদিক, কন্ট্রিবিউটর হিসেবে। বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত এবং বেকার সাংবাদিকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল সাপ্তাহিক সুগন্ধা। অনেকটা মুক্ত মঞ্চের মতো। লেখার জন্য সম্মানী দেয়া হতো।
অনেক আইটেমের চাপে কোন রিপোর্ট ছাপা না হলেও দেয়া হতো লেখার বিল। এ কথা এখনো স্মরণ করেন রাশিদুল ইসলাম। অনেক হাউজ ঘুরে দিগন্ত টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর “ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো” রাশিদুল আবার গেছেন নাঈম ভাইয়ের আমাদের সময় ডটকম-এ। আমরা দৈনিক সকালের খবর ও দৈনিক আমাদের সময়-এ একত্রে কাজ করেছি।
আমার সময়ে সুগন্ধায় প্রতি সংখ্যায় কলাম লিখতেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান, আবেদ খান, মতিউর রহমান চৌধুরী, নঈম নিজাম, আলতাফ মাহমুদ, শাজাহান সর্দার (সাজু সর্দার), আজিজুল হক বান্না, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ।
নিয়মিত রিপোর্ট দিতেন রাশিদুল ইসলাম, কাজী আবদুল হান্নান, পারভেজ আলম চৌধুরী, আবু দারদা যোবায়েরসহ অনেকে। তরুণদের রিপোর্টের জন্য দেয়া হতো দুইশ থেকে তিনশ টাকা। সিনিয়রদের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রতি লেখায় পাঁচশ টাকা। সাধারণত সিনিয়রদের কলাম হতো এক পৃষ্ঠার। তবে একজন ছিলেন যিনি কখনো এক পৃষ্ঠা লেখেননি, আধা পৃষ্ঠা লেখারও উদাহরন আছে একাধিক।
সুগন্ধার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিলো আমার হাতে। দ্বিতীয় নিয়ন্ত্রক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই অবস্থান করে নিয়েছিলেন মাসুদ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের মেধাবী ছাত্র মাসুদ কামাল শুরুতে সুগন্ধাকে সঠিক ধারার সাংবাদিকতা হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। হয়তো কোন দিনই পারেননি।
কিন্তু এই বিরূপ ধারনার কোন প্রভাব পড়েনি তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। মাসুদ কামালের এই এক অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য; পছন্দ না হলে বিরোধিতা করতো প্রকাশ্যে। কিন্তু অমান্য করার প্রবণতা তাঁর ছিল না। আর পেছনে গুসুরগুসুর-ফুসুরফুসুর করা তো অনেক দূরের বিষয়। সেই সময় আমার সিদ্ধান্ত কেউই অমান্য করতেন না। অবশ্য সেই সুযোগও ছিলো না। যে কারণে পত্রিকা ছাড়া আমাকে ‘ইনহাউজ পলিটিকস’ নিয়ে মোটেই ভাবতে হয়নি। সুগন্ধার এ শৃংখলার মূলে ছিলেন মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন।
আমরা মোজাম্মেল ভাইর নেত্রত্বে সুগন্ধার ধারা হঠাৎ বাদ না দিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করার কৌশল অবলম্বন করেছিলাম। যাতে আগের পাঠক হোচট না খায়। এ ধারায় আগের পাঠকের সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন পাঠক। সাপ্তাহিক সুগন্ধা তখন বর্ষার টৈটুম্বুর নদীর মতো। কাজেই মোজাম্মেল ভাই কী বলেন, আর কী করেন- তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাবার অবস্থায় আমরা ছিলাম না।
এদিকে আমাদের সঙ্গে বিরোধের জের মৃত সাপের মতো দৃশ্যমান থাকতে থাকতেই মোজাম্মেল ভাই আর এক মহা বিরোধের দিগন্ত উম্মোচন করলেন। কাউকে কিছু না বলে সুগন্ধা ছাড়ার স্টাইলে একদিন সূর্যোদয়ও ছেড়ে দিলেন। এবার চাকুরী অথবা ভাড়ায় নয়, নিজের মালিকানায় প্রকাশ করার কারনে আজকের সূর্যোদয়। এবং সুর্যোদয়ের লোগো হুবহু কপি করে ‘আজকের’ শব্দটি এমনভাবে দিলেন যা চোখে পড়ার মতো ছিলো না।
মোজাম্মেল ভাই হঠাৎ সূর্যোদয় ছেড়ে দেয়ায় পত্রিকাটির কাগজ পত্রের মালিক গোলাম মোহাম্মদ চাষীর কোন ক্ষতি হয়নি। কারণ, তার পত্রিকাটি আগে থেকেই বন্ধ ছিলো। কিন্তু বিপাকে পড়লেন সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুস ছামাদ চৌধুরী। ডাক নাম কয়েস। সংসদ নির্বাচনে তার একাধিক বার পরাজিত ও একাধিক বার বিজয়ী হবার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু সংবাদ পত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি কেবল পরাজিত হলেন। মোজাম্মেল ভাইর উপর ভরসা করে সূর্যোদয়ে তিনি অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তার পুরো টাকাই জলে যাবার জোগার হলো। তিনি পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এবার দুইএকজন ছাড়া আর কেউ মোজাম্মেল ভাইর সঙ্গে যায়নি। প্রায় সবাই সূর্যোদয়েই থেকেগেলো ইকবাল কবীর ও খন্দকার জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে। সমানে প্রকাশিত হতে লাগলো সূর্যোদয় এবং আজকের সূর্যোদয়। এবং শুরু হলো দুই পত্রিকার মধ্যে বিষোধগারের সুনামী। এভাবে বছর খানেক চলার পর বিরক্ত হয়ে অতিশয় ভদ্রলোক মাহমুদুস ছামাদ চৌধুরী সূর্যোদয় বন্ধ করে দিলেন।
এদিকে গেদুচাচার খোলাচিঠি মোজাম্মেল ভাই তার পত্রিকা “আজকের সূর্যোদয়”-এ অনৈতিক ও বেআইনীভাবে অব্যাহত রাখলেন। তবে এ নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যথা ছিলো না। কারণ তার ভাড়ায় নেয়া সুর্যোদয় বা নিজের মালিকানার আজকের সূর্যোদয় কখনই সুগন্ধার ধারে কাছেও পৌছাতে পারেনি; টেক্কা দেয়া তো দিল্লী দুরস্থ! এক পর্যায়ে তিনি পত্রিকাটি সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক করলেন।
এদিকে আমার নেতৃত্বে বছর সাতেক দাপটের সঙ্গে চলার পর সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন শুরু করলেন অন্য রকম ভাবনা। এ ক্ষেত্রে তাকে বুদ্ধি-পরামর্শ যোগাতে শুরু করলেন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। যাদেরকে আমি সুগন্ধায় সংযুক্ত করেছিলাম। তবে এদের কাউকেই সৈয়দ মোয়াজ্জেম সুগন্ধার দায়িত্ব দেননি। দায়িত্ব নিলেন নিজেই! পুত্রের জন্য কন্যা দেখতে গিয়ে নিজেই বিয়ে করে ফেলা এক পীরের মতো।
বছর খানেক “অক্লান্ত পরিশ্রম” এবং বহু টাকা গচ্ছা দেবার পর অনুধাবন করলেন, এ কম্ম তার নয়! কিছু দিন পর পত্রিকাটি আমাদের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিলেন। সামনে ছিলেন সেইসময় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার মিয়াজী। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিয়াজী পত্রিকাটি নিয়েছিলো আমার উৎসাহে এবং আমাকে প্রোভাইড করার জন্য।
আমি সাত্তারকে অনুরোধ করে পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত করি আমার ঘনিষ্ঠজন সন্তোষ শর্মাকে। সাপ্তাহিক সুগন্ধা আমাদের যৌথ মালিকানা থেকে এক পর্যায়ে মেধাবী সন্তোষ শর্মার একক মালিকানায় চলে গেছে। সে আরএক কাহন।
অালম রায়হান, দৈনিক দখিনের সময়।