ভার্চুয়াল নির্ভরতায় আটকে গেছে মানুষ – রিন্টু আনোয়ার

করোনা মহামারি পরবর্তী বিশ্বের চেহারা কী দাঁড়াবে? কী হাল হবে অর্থনীতির?- সেটা নিয়ে ভাবনা-গবেষণা দেশে-দেশে। গড়পড়তা ধারনা হচ্ছে, মহামারি একদিন ঠিকই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তার আগ পর্যন্ত সময়টাতে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয়ে গেছে এবং আরো ক্ষতি হবে। সেটা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে।

তদ্দিনে দেখা যাবে এক নতুন দেশ, নতুন বিশ্ব। যার আলামত এরইমধ্যে স্পষ্ট। জীবনহানির সঙ্গে জীবিকার দুর্বিপাক মোকাবেলায় দেশে-দেশে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিতে ভর করেছে। বাধ্য হয়েই তাদের এই নির্ভরতা। কেনাকাটা, চিকিৎসা, পড়াশোনা, অফিস-ব্যবসা সব কিছুতে ভার্চুয়ালনির্ভরতা এখন আঠার মতো লেপ্টে গেছে মানুষের জীবনে। তা গড়িয়েছে রাজনীতি থেকে আদালত পর্যন্ত।

এই মহামারির সময় জেকে বসা তথ্যপ্রযুক্তির শটকাট পদক্ষেপ জনজীবনে পাকাপাকি হয়ে যেতে পারে। দাঁড়াতে পারে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে। সামনের দিনগুলোতে সামাজিকতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির কী দশা হবে, তার ভয়ংকর সব পূর্বাভাস এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি। আইএমএফ এর মতে, এবছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে তিন শতাংশ।

মহামারি দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। মানুষের আচরণে মানবিক পরিবর্তণ এরইমধ্যে স্পষ্ট। মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ কমে গেছে। অন্যের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে ভর করা ভয় কবে কখন কাটবে-কেউ বলতে পারে না। আর মানুষের এই আচরণের কারণে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নতুন ধরণের সেবা, শিল্প, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে উঠবে। কম্পিউটার বিজ্ঞান আর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের এ প্রাধান্য আরো বাড়বে।

সময়ের প্রয়োজনেই নতুন পদ্ধতি ও ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। করোনায় প্রথম আক্রান্ত চীনেই প্রথম গোড়াপত্তন অনলাইননির্ভরতা। অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় চীনে অনলাইন ব্যবসা বাড়ছে খুব দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে এই বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের পর দেশটির যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ব্যবসা করে তাদের প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তা যাতে ছড়িতে পড়তে না পারে সেটা নিশ্চিতে দেশটির সরকার সাধারণের চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছে বাড়িতে অবস্থানের। এরপর থেকে সাধারণ মানুষ তাদের নিত্যদিনের কেনাকাটার জন্য ঝুঁকেছেন অনলাইনে।

চীনের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য বিরাট একটা অংশ ব্যয় করেন এবং এখনও পর্যন্ত সেখানে অনলাইন শিক্ষার প্রিমিয়ার সার্ভিস হিসেবে ভিআইপিকিডসের মতো ইংরেজি শিক্ষার সার্ভিসগুলোই জনপ্রিয়। দেশটির পুরো জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। চীনের বিনোদন ব্যবসাও অনলাইন ভিত্তিক হয়ে গেছে। নববর্ষের ঠিক আগ মুহূর্তে সিনেমা হলগুলোর পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মুভির রিলিজ।

বিশেষ করে চীনের নতুন বছরের ছবি লস্ট ইন রাশিয়া এবং এন্টার দ্য ফ্যাট ড্রাগন এখন অনলাইনেই স্ট্রিমিং করে দেখছেন দেশটির নাগরিকরা। এই সময়টাতে অনলাইন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে বাইডুর ইকি কিংবা টেনসেন্ট ভিডিওর জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় অনলাইন গেমস এবং টিকটকের মতো ভিডিও অ্যাপগুলোও বেশ উপকারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ভাইরাসের হানায় জিম কিংবা খেলাধুলা করে সময় কাটানোর সুযোগ না থাকায় লোকজন এগুলোর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছেন। কীভাবে বাসায় বসেই জিম করবেন এমন তথ্যদানকারী অ্যাপ কিংবা লাইভ ক্লাসে যোগদান করে ঘরে বসেই জিম বা ইউগা ব্যায়াম করার মতো বিষয়গুলোর প্রতি ঝুঁকছে মানুষ।
ভার্চুয়ালের এ জয়জয়কারে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই।

ক্ষেত্র বিশেষে কারো কারো চেয়ে এগিয়ে। বদলে গেছে শহুরে লাইফস্টাইল। অনলাইনে ঘর থেকেই চলছে অফিস, বাচ্চাদের স্কুলের ক্লাস। নতুন এই জীবনে মানুষের মৌলিক চাহিদার মতো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে একটি মোবাইল সেট আর উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। ঘরবন্দি এই সময়ে জীবনকে গতিশীল রেখেছে প্রযুক্তির স্পর্শ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে মিটিং করছেন। মন্ত্রীর ব্রিফিং, সংবাদ সম্মেলন সবকিছুই চলে এসেছে অনলাইনে, প্রযুক্তির আওতায়। শুধু কি তা-ই, গানের অনুষ্ঠান, বিশেষজ্ঞদের বাজেট ভাবনা—এসব কিছুও আলোচনা হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। এমনকি টেলিভিশনের টকশোগুলোতে সবাই অংশ নিচ্ছেন যার যার ঘরে বসেই।

হাটবাজারও চলে আসছে ঘরে। করোনা আক্রান্তরা হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক টেলিফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। নিচ্ছেন চিকিৎসা সেবা। সময়ের প্রয়োজনেই বদলে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সব ব্যবস্থা, মানুষের আচরণ। বদলে যাচ্ছে অফিস-আদালতে স্বাভাবিক নিয়মকানুন। সময়ের দাবি বদলে দিচ্ছে সবকিছু। শারীরিকভাবে যখন কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই, তখন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমই সবাইকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। নিয়ে এসেছে একেবারে হাতের নাগালে।

করোনা দেশের রাজনীতির প্যাটার্নও বদলে দিয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজপথের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রম বন্ধ। গত মাস কয়েকে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাও প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে ‘লকডাউন’ সীমিত করার সমালোচনা করেছেন।

ইতোমধ্যে কয়েকটি দল কারফিউ ঘোষণার দাবি করেছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ লকডাউন শিথিল করার পক্ষে গণমাধ্যমে যুক্তি তুলে ধরেছেন, আবার কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কাও করেছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও তথ্যপ্রযুক্তি এখন অব্যর্থ অস্ত্র। পরাজয়ের যেন কোনো ঝুঁকিই নেই। আত্মবিশ্বাসও বেশি। ভার্চুয়ালে প্রচারিত তথ্য সত্য না মিথ্যা, তা প্রমাণের অপেক্ষা থাকছে না।

এর আগেই তা সত্য হিসেবে প্রচারে-প্রসারে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাচ্ছে। নাজেহাল হয়ে বাদ-প্রতিবাদের শক্তিও হারিয়ে ফেলছে কমজুরি প্রতিপক্ষ। অথবা ততক্ষণে আরেক ইস্যু নিয়ে আসা হচ্ছে বাজারে। ততক্ষণে আগেরটি বাদ দিয়ে নতুনটি নিয়ে যতো মাতবোল। ভার্চুয়াল জগতের এ ক্যারিশমা টের পেয়ে দুর্বল ব্যক্তি-গোষ্ঠিও এখন ঝুঁকছে এ চেষ্টায়। যথাসাধ্য ফায়দাও বা বরকতও পাচ্ছে।

নিজেদের পক্ষে, প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রতিযোগিতাটি অনেকাংশেই একতরফা। মনগড়াও। প্রতিপক্ষকে কেয়ার বা ধার ধারার দরকারই পড়ছে না। এর মূল কারণ এ প্রতিযোগিতায় অ্যাকচুয়াল বিষয়টিই প্রশ্নাতীত। কখনো সত্যকে ফুলিয়েফাপিয়ে মহাপ্রচার। কখনো আধা সত্যকে পুরো সত্য করার চেষ্টা। কখনো সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রন। আবার কখনো আজগুবি-অবান্তর। হাল নমুনায় যে যেদিক দিয়ে পারছে নানা তথ্য, জরিপ, গবেষণা রিপোর্ট, ছবি ছড়ানোর ধূম তুলছে। কখনো বিদেশি কোনো প্রচারমাধ্যম বা সংস্থার বরাত দিয়ে আচ্ছারকমের তথ্যবাজি।

আমাদের ধান, পাট, চাল, ছাগল, গরু কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না। আমাদের আলো-বাতাস, পানি, ড্রেন-টয়লেটও তাদের কাছে সাবজেক্ট। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, পরিবেশ নিয়ে জরিপের কোনো শেষ নেই। রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য্য, বাসযোগ্যতা নিয়েও একেবারে সাংঘর্ষিক তথ্যসমৃদ্ধ জরিপ নজরে পড়ছে। ভার্চুয়ালে পরস্পরকে ঘায়েল করার এ যুদ্ধে কেউ ঠকছে না। সবাই জয়ী হচ্ছে। আজ হারলেও কাল জিতছে বেশি লাইক, কমেন্টস, শেয়ারে।

ভার্চুয়ালে নানা জরিপে সরকারের আকাশ ছোঁয়া সাফল্যের প্রচারণার ঠিক উল্টোটাও চলছে। এ সরকারের কারণে দেশের মহাসর্বনাশের নানা খবরে মানুষ মাথায় হাত দিয়ে ফেলছে। বিভিন্ন দলকে জেতানো- হারানোর ভার্চুয়াল এ গেমে মানুষের গরজ কম হলেও আগ্রহ কম নয়। আলোচনা-সমালোচনা প্যাঁচালি হিসেবে চমৎকার।

জরিপ পয়দা ও প্রচারকারী সংস্থাগুলোর কদর বাড়ছে। জরিপ মন মতো হলে একপক্ষ বেদম খুশি। ধুমছে প্রচার। অন্যপক্ষের তখন একমাত্র দায়িত্ব দ্রুত পাল্টা তথ্য প্রচারের এন্তেজাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভার্চুয়াল নির্ভরতা মানুষের মানসিক মনোযোগ, সময়, স্মৃতি ক্ষমতায় ছেদ ফেলছে। উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে।

স্মার্টফোনসহ ভার্চুয়াল ব্যস্ততার নেতিবাচক দিকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত লেখক যাযাবারের বিখ্যাত সেই মন্তব্য বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনি বলে গেছেন- ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ। কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস।’

সেই আবেগ হলো কাগজের চিঠি, মনোযোগ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, কাজের প্রোডাকটিভিটি, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, রাতের ঘুম, বন্ধুদের আড্ডা, সামনে বসে গল্প করার আনন্দসহ অনেক কিছু।

শিশুদের বিকাশে এর নেতিবাচক প্রভাব বাদে কেবল বড়দের জীবনে এই নেশা সিগারেট বা আফিমের চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়। এরপরও প্রয়োজন ও বাস্তবতাই বড় কথা। যুক্তি-তথ্য এ খানে প্রাধান্য পায় না। বেঁচে থাকা এবং জীবিকার প্রশ্নে যা জরুরি, তা-ই করছে-করবে মানষ।
লেখক – রিন্টু আনোয়ার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *