গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান’ এভাবেই গেয়ে উঠতেন সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
১১ জ্যৈষ্ঠ ২৫ মে‘ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতমপ্রাণপুরুষ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাঙালির আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী কবির ১২১তম জন্মজয়ন্তী ।
১৮৯৯ সালের ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এইদিনে ভারতের বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে) আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কাজীপরিবারে নব জাগরণের এ কবির জন্ম।
বিদ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের কবি হিসেবেও বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা নজরুল ইসলামকে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বিংশশতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছেন কবিতা ও গানে। ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কবিতা ও গানলিখে বিদ্রোহী কবি হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন নজরুল ইসলাম। রচনা করেন ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’র মতোকবিতা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকার কবিকে জেলে পাঠায়। সেখানে বসে কবি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বাংলাসাহিত্যে নজরুল ইসলামের আবির্ভাবকে ধুমকেতুর আত্মপ্রকাশ হিসেবেও দেখেন অনেকে।
তাঁর গান, কবিতা শুধু বাঙালিকে আনন্দই দেয়নি, লড়াই-সংগ্রামে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। যেখানেই অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, অসাম্য সেখানে উচ্চারিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের নাম।
বহুমুখী প্রতিভার এ কবি বাংলা সাহিত্যের বিশাল অঙ্গনে ভূমিকা রাখেন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবে।সাহিত্য কর্মের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে তার গান। প্রায় ৩ হাজার গান রচনা করেন নজরুল ইসলাম। ইসলামি গজল লিখে বাংলা গানে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। গান রচনার পাশাপাশি সেগুলোতে সুরারোপ করে সমৃদ্ধ করেছেন সঙ্গীতাঙ্গনকে। নাটক লিখেছেন, ছেলেবেলায় লেটো দলে যোগ দিয়ে নাটকে অভিনয় করেছেন, পরিণত হয়ে লিখেছেনও নাটক। চলচ্চিত্রেরচিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনা এবং অভিনয়ও করেছেন।
বরেণ্য এ কবি নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়।মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতা কাজী ফকির আহমেদকে হারিয়ে এলামেলো হয়ে যায় সামনে চলার পথ। আর্থিক অনটনে পড়ে বইখাতা রেখে রোজগারে নেমে পড়তে বাধ্য হন নজরুল। কখনও মসজিদের ইমামতি, মাজারেরখাদেমগিরি, চায়ের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে তাকেছেলেবেলায় তার নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’।
আসানসোলের চারুটির দোকানে রুটির কাজ করার সময় সেখানে কর্মরত দারোগা রফিজ উল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। তিনি কিশোর নজরুল কে নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
১৯৪২ সালে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, বাংলা
সাহিত্যের অনন্যপ্রতিভার এ কবি পিকস ডিজিজে আক্রান্ত। এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন চিরবিদ্রোহী এ কবি।এতে তার সাহিত্যচর্চা পুরোপুরি থেমে যায়।
কোলকাতায় পারিবারিক তত্ত্বাবধানে থাকা বাকরুদ্ধ এ কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা হয় নজরুলইসলামকে। অভিসিক্ত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়।
চিরবিদ্রোহী ও সাম্যের এ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতাল বৰ্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
‘আজান’ কবিতায় চাওয়া কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় চির জাগরণের এ কবিকে, যা ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন।
বিদ্রোহী কবির ১২১তম জন্তজয়ন্তীতে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। এবং মহান আল্লাহর কাছে বৈশিক মহামারী করোনার সংক্রমণ থেকে দেশ জাতি ও বিশ্ব বাসীর মুক্তি কামনা করছি।
‘শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক’
অন্যায় অবিচার দূর হোক,
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ হোক,
মেহনতি মানুষের জয় হোক।
লেখক : মোঃ মাসুম বিল্লাহ।
যুগ্ন সাধারন সম্পাদক- সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী সোসাইটি, যুক্তরাজ্য।