পড়াশোনার জন্য শিশুদের অতিরিক্ত চাপ দেবেন না: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 

বাসস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে শিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলার মাধ্যমে কোমলমতি শিশুদের মেধা ও মননের যথাযথ বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার জন্য অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি এটুকুই বলবো, কোনমতেই যেন কোমলমতি শিশুদের অতিরিক্ত চাপ না দেয়া হয়। তাহলেই দেখবেন তারা ভেতরে একটা আলাদা শক্তি পাবে। আর তাদের শিক্ষার ভীতটা শক্তভাবে তৈরি হবে।’

কোমলমতিদের লেখাপড়ার কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করাকে ‘এক ধরনের মানসিক অত্যাচার’ বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, শিশুরা প্রথমে স্কুলে যাবে এবং হাসি খেলার মধ্য দিয়েই লেখাপড়া করবে।

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সম্পৃক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে নির্দেশ দেন।

শিশুদের পাঠদান সম্পর্কে নিজস্ব অভিব্যক্তি সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশেই ৭ বছরের আগে শিশুদের স্কুলে পাঠায় না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা স্কুলে যায়। কিন্তু তারা যেন হাসতে খেলতে মজা করতে করতে পড়াশোনাটাকে নিজের মত করে করতে পারে সেই ব্যবস্থাটাই করা উচিত।

সেখানে অনবরত ‘পড়’, ‘পড়’, ‘পড়’ বলাটা বা ধমক দেওয়াটা বা আরো বেশি চাপ দেয়া হলে শিক্ষার ওপর তাদের আগ্রহটা কমে যাবে, একটা ভীতির সৃষ্টি হবে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি সেই ভীতিটা যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমি আমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকদেরকে অনুরোধ করবো।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় আমরা দেখি প্রতিযোগিতা শিশুদের মধ্যে না হলেও বাবা-মায়ের মধ্যে একটু বেশি হয়ে যায়। এটাকেও আমি একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলে মনে করি।’

তিনি বলেন, সকল শিক্ষার্থীর সমান মেধা থাকবে না এবং সকলেই সবকিছু একরকম করায়াত্ত করতে পারবে না। তবে, যার যেটি সহজাতভাবে আসবে তাঁকে সেটি গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া, যেন শিক্ষাটাকে আপন করে নিয়ে সে শিখতে পারে সে সুযোগ দিতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেন স্বাগত বক্তৃতা করেন।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ‘প্রাথমিক শিক্ষা পদক’ বিতরণ করেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

অনুষ্ঠানে প্রথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ডের ওপর একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়।

প্রাথমিক শিক্ষাটা যেন আরো উন্নত এবং মান সম্মত হয় তার প্রতি দৃষ্টি রাখছে তাঁর সরকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকল শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৮-২০২৩ মেয়াদের জন্য ৩৮ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।’

শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ে সরকারের কোন কার্পণ্য নেই উল্লেখ করে তিনি তাঁর সরকারের শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের কল্যাণমূলক কার্যক্রমও আলোচনায় তুলে আনেন।

তিনি বলেন, ‘শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু, ঝরেপড়া রোধকল্পে বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে স্কুলের পোশাকসহ সকল শিক্ষা উপকরণ প্রদান, শিক্ষা ভাতা ও ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষার ফি প্রদান করাসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য তাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্যও বই প্রদান ও হেয়ারিং এইড প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সম্পৃক্ত করার আহবান জানিয়ে বলেন, তাঁর সরকার এজন্য প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছে। পর্যায়ক্রমে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য এই মিনি স্টেডিয়াম ইউনিয়ন পর্যায়েও করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে।

এসব স্টেডিয়ামে সারা বছরই যেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলার আয়োজন থাকে সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্যও তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষতে আহ্বান জানান।

এ সময় প্রতিটি স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় তাঁর সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এভাবেই শিক্ষাকে আমরা সার্বজনিন ও বহুমুখী করে দিচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, এরফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ফুটবল প্রতিভা বের হয়ে আসছে, যারা বিদেশ থেকে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্কাউটিং এবং কাবিং যেন প্রত্যেক বিদ্যালয়ে চালু হয় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার জন্যও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি তাগিদ দেন।

তিনি বলেন, ‘স্কাউটিং এর মাধ্যমে তাঁদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়, তাঁরা শৃংখলা শেখে, নানা ধরণের উদ্ভাবণী কাজ করতে পারবে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।’

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম করেছি এবং এটা সব জায়গায় পর্যায়ক্রমিকভাবে করে দেব এবং মাধ্যমিকের মত প্রাথমিক পর্যায় থেকেও কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে এবং প্রতি দুই কিলোমিটারের মধ্যে যেন একটা বিদ্যালয় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার সমগ্র দেশে প্রায় ১৫ হাজার নতুন বিদ্যালয় করে দিয়েছে এবং উন্নতকরণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে, বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে যাতে তাঁরা ভালোভাবে শিক্ষা দিতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী এসময় ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে এজন্য কোমলমতিদেরকে বেশি চাপ প্রয়োগ না করারও পরামর্শ দেন।

প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাপানো প্রশ্নপত্র প্রদানের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘শিশু শ্রেণীর শিক্ষাথীরা স্কুলে যাবে শিখতে, তারাতো আগে থেকেই পড়ে আসবে না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে সব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে সেখানে স্কুলে যাবার বয়স হয়েছে এমন শিশুদের সেসকল স্কুলে ভর্তি করে নিতে হবে। ’ স্কুলে ভর্তি হওয়াকে শিশুদের অধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিশুরা যেন বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে সেই ব্যবস্থাটা নিতে হবে।’ তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান।

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণে তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এসময় শিক্ষাকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেন। ঝরেপড়া রোধকল্পে তাঁর সরকারের বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান, ১ কোটি ৪০ লাখ মায়ের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা পৌঁছে দেয়াসহ সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি এবং স্থানীয় উদ্যোগে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি স্কুল দরকার হলে টিফিন তৈরি করে দেবে, না হলে বাচ্চার মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য টিফিন তৈরী করে দেবে। এটা প্রত্যেক মা এবং অভিভাবককেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি চালুর ফলে আমরা দেখেছি অনেক জায়গাতেই এখন ঝরেপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।’

তিনি এ সময় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (অটিজম আক্রান্ত বা প্রতিবন্ধী) শিশুদের শিক্ষার বেলায়ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, সহপাঠি এবং বিদ্যালয় কতৃর্পক্ষকে যতœবান হবার আহবান আহবান জানান, যাতে করে মূল ¯্রােতে যুক্ত হয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকারের পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা শিক্ষা জীবনের শুরুতেই একটি সনদপত্র পাওয়ায় তাদের যেমন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে তেমনি পরীক্ষা ভীতিও দূর হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এগুলো এজন্য করা হয়েছে যেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাটাকে কোন ভীতির বিষয় মনে না করে।’

শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী আজকের শিশুদের আগামীতে দেশের নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা নিয়ে গড়ে ওঠার পরামর্শ দেন।

তিনি শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ হিসেবে যেন আজকের কোমলমতিরা গড়ে উঠতে পাওে সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্যও তাদের প্রতি আহবান জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *