দুর্নীতি দমন ব্যাবস্থার সম্প্রসারন প্রয়োজন | বাংলারদর্পন

নিউজ ডেস্কঃ

দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার সেবা এবং নিরাপত্তাসহ নানা নাগরিক পরিষেবা দিতে বেড়েছে অনেক সরকারি দপ্তর। দপ্তর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি। এই সম্প্রসারিত দুর্নীতি দমন করতে দুর্নীতি নির্মূল দপ্তরের কতটা প্রসারণ ঘটেছে তা দেখার বিষয়।

 

প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? প্রবাদটির উৎপত্তি নাকি এই কারণে, প্রাচীনকালে সব ইঁদুর এক সভায় মিলিত হয়েছিল। ওই সভায় আলোচ্য বিষয়টি ছিল- বিড়ালের কবল থেকে ইঁদুর সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। বিড়াল ওই সময় নির্বিবাদে ইঁদুর নিধন করতে শুরু করে, তাই সেই সময়কার সব ইঁদুর সভায় বসে সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিড়ালের গলায় একটি ঘণ্টা বেঁধে দেয়ার। আর এই ঘণ্টা বাঁধা হলে বিড়ালের আগমনে ঢং ঢং শব্দ হবে আর এই শব্দ শুনে সব ইঁদুর প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে। বিপত্তিটা হলো কোন ইঁদুর যাবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে, যে যাবে তাকেই তো বিড়ালের পেটে চলে যেতে হবে। তাই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কোনো ইঁদুরই পাওয়া গেল না। দেশের দুর্নীতি নির্মূলের বিষয়টাও অনেকটা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতো অবস্থা। কারণ যারা দুর্নীতিবাজ তাদের নেপথ্য হাত বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। আর এই কারণে দুর্নীতিবাজদের নির্মূলে কার্যকরী বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ তেমন একটা দেখা যায় না। আরেকটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় তা হলো কিছু এনজিও এবং কথিত সিভিল সোসাইটি প্রতিনিয়ত দুর্নীতি নির্মূলে সভা সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেই চলেছে। কিন্তু কে এই দুর্নীতিবাজদের ধরবে তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই, এমনকি এমন কিছু এনজিও বিদেশি সাহায্য এনে এ ধরনের সেমিনার করে থাকে, তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাদের ভেতরেই রয়েছে দুর্নীতির আখড়া। সুতরাং এখানে বিষয়টি অনেকটা সর্ষের ভূতের মতো অবস্থা। দেশে নানা বিষয়ের দুর্নীতির শিকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে দুর্নীতির ধরন, গড়ন এবং পদ্ধতিতে পেয়েছে বহু মাত্রিকতা। যেমন এক সময় দুর্নীতির মূল বিষয় ছিল ঘুষ আর এই ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মাঝে বিনিময় হতো নগদ টাকা। এখন এই ঘুষ দেয়া-নেয়ার ধরনও পাল্টেছে, যেমন এই টাকা লেনদেন নগদে না হয়ে হচ্ছে ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ, এটিএম বুথের মানিট্রাক, ক্রেডিট কার্ডসহ নানা আধুনিক পদ্ধতিতে।

 

দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার সেবা এবং নিরাপত্তাসহ নানা নাগরিক পরিষেবা দিতে বেড়েছে অনেক সরকারি দপ্তর। দপ্তর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি। এই সম্প্রসারিত দুর্নীতি দমন করতে দুর্নীতি নির্মূল দপ্তরের কতটা প্রসারণ ঘটেছে তা দেখার বিষয়। দেশের দুর্নীতি নিরসন করতে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন যার আগের নাম ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এই দুর্নীতি দমন ব্যুরোর অভিযাত্রা শুরু ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৩ সালে। ২০০৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই সংস্থাটির নামকরণ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোগত দিকটার পরির্বতন ঘটলেও মাঠ পর্যায়ের অবস্থা রয়েছে অনেকটা পুরাতন আমলেরই মতো।

 

এখানে কথা হচ্ছে, দুর্নীতির পরিমাণ যে হারে বাড়ছে দুর্নীতি দমনের জনবল সে হারে বাড়েনি। এখনো প্রতিটি জেলা সদরে দুর্নীতি দমন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ অফিস নেই। বৃহত্তর ১৯টি জেলা সদরে অবস্থিত অফিস থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মীরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই কমিশনের জনবল কাঠামো অন্য যে কোনো দপ্তরের চাইতে অনেকটা ভিন্ন। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলেও এই দুদক দুর্নীতির সব ক্ষেত্র নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারবে না তার কারণ জনবল এবং দপ্তরের অপ্রতুলতা। যেমন বৃহত্তর রাজশাহী জেলার (সাবেক জেলা) প্রত্যন্ত এলাকার একজন ইউপি মেম্বার বা সরকারি কর্মীর দুর্নীতির বিষয়টি দুদকের কর্মীরা মনিটরিং করেন রাজশাহী শহর থেকে। রাজশাহী বা এ রকম বৃহত্তর জেলায় অবস্থিত দুদকের অফিস থেকে এ ধরনের দুর্নীতি নিরসনে আদৌ কি কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারবে দুদক। এর জন্য দুর্নীতির করাল থাবা সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রাজশাহীর সাবেক এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন জনৈক ব্যক্তি। এই অভিযোগটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্নীতির রাহুগ্রাস দেশের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। অভিযোগে বলা আছে, সাবেক এই ওয়ার্ড কমিশনার পাহাড়সম দুর্নীতি করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সরকার পরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তি তার খোলস পাল্টেছেন অর্থাৎ সব সময় তার অবস্থান সরকারি দলে। ফলে তার দুর্নীতি এবং অপরাধগুলো কখনো ধরাছোঁয়ায় আসে না। রাজশাহী মহানগরীর ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নির্বাচিত কাউন্সিলর পদটি হাতিয়ার বানিয়ে আম চত্বর ও তার আশপাশে এলাকার ভ‚মি নির্বিবাদে দখল করেছেন। তিনি আজ ১০০ কোটি টাকার মতো সম্পদের মালিক। এত টাকা তার পক্ষে বৈধভাবে আয় করা কোনো দিন সম্ভব ছিল না। কারণ যতদূর ওই অভিযোগটায় উল্লেখ আছে তা থেকে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিতার কর্মজীবন শুরু করেন একজন সাইকেল মেকানিকের সহকারী হিসেবে। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা মানুষটির এই উত্থানে এলাকার মানুষ হতবাক। তার এই শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। তার পৈতৃক সম্পত্তি বলতে এক টুকরো ভিটে ছিল। আজ তিনি ১৮ লাখ টাকা দামের গাড়িতে চড়েন। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাড়া অন্য কোনো উল্লেখ করার মতো পেশা তার নেই। আর এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পেশা থেকে কী করে এত বিত্তবৈভব গড়ে তুললেন তা অনেকেরই অজানা। তার জ্ঞাত আয় দ্বারা এই সম্পদ করা সম্ভব না। অভিযোগে সাবেক কাউন্সিলরের সম্পত্তির যে বিবরণ দেয়া হয় তা আলাদীনের চেরাগ পেয়ে ধনী হওয়ার মতো।

 

স্থানীয় সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, সেই সময়কার একজন কমিশনার মাসিক ১৫ হাজার টাকা সম্মানী পেতেন। আনুষঙ্গিকসহ যোগ করলে দেখা যাবে যে, তৎকালীন সময়ের একজন কমিশনার সর্বসাকুল্যে আয় ২০ হাজার টাকার অধিক নয়। তাহলে প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিক একজন কাউন্সিলর রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হন কীভাবে। তার এই অসততা, দুর্নীতি ও অপকর্ম নিয়ে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক সোনালী সংবাদে ৬-৩-২০০৭ তারিখে এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সমকালে ১৪-৯-২০০৯ তারিখে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর এ ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করতেও ভয় পায়। অন্যদিকে দুদকের জনবল এবং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দুর্নীতিবাজরা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

 

প্রশাসনিকভাবে দুদকের কর্মরতদের পদবি অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদবির মতো এক নামের হলেও গ্রেডগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি কর্মীদের এক ধরনের ইগোর সমস্যা থাকে। কার গ্রেড কার চেয়ে বড় এই নিয়ে। তাই দেখা যায়, একজন উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে দুদকে কর্মরত তার চেয়ে একটু নিচু গ্রেড পদমর্যাদার কর্মী যখন প্রাথমিকভাবে কিছু জানতে চান তখন তাদের মাঝে সেই ইগো প্রবলেমটা দানা বাঁধে। সম্প্রতি সিভিল সার্জন এবং এডিসির হাতাহাতি থেকে বুঝা যায় যে সরকারি কর্মীদের ইগোর প্রবলেমটা কতটা ভয়াবহ।

 

দেশের দুর্নীতি নিরসন করতে হলে দুদককে আরো শক্তিশালী করা দরকার। দুদককে সত্যিকারের স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সব স্তরের কর্মী নিয়োগসহ সব কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের মতো দুদক পরিচালিত করলে এই কমিশন আরো শক্তিশালী হবে। অন্য কোনো সরকারি দপ্তর থেকে এখানে কর্মীকে পদায়ন না করাটা উচিত। দুদকের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অফিস থাকা দরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন যদি প্রয়োজনীয় জনবল এবং স্বাধীনভাবে কাজ করে তাহলে দেশের দুর্নীতি নিরসন করা সম্ভব। তখন আর বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য কাউকে খুঁজতে হবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *