নির্বাচনী ভাবনা : আওয়ামী লীগের আসল শত্রু নিজেরাই, বাইরের কেউ নয়

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী :

 

নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহু স্থানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ঘটছে। রাজধানীসংলগ্ন মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় সাদেক খান নামের এক প্রার্থীর সমর্থকরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগের আরেক গ্রুপ তাদের ওপর হামলা চালায়। দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় গাড়িচাপা পড়ে দুই ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তিদানের ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে জানাই এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ আরও বহু স্থানে চলছে। তা শুরু হয়েছে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার আগেই। রাজবাড়ীর একটি কেন্দ্রের এমপি জিল্লুল হাকিম। তিনি তিন দফা আওয়ামী লীগদলীয় এমপি পদে আছেন এবং এলাকার জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজও করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণের নানা অভিযোগ। আমি গত বছর রাজবাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন তার বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ জানতে পারি।

 

এবার এই এলাকা থেকে মোহাম্মদ মেহেদী হাসান নামে লন্ডন প্রবাসী এক যুবক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী হয়েছেন। তাকে আমি চিনি বলেই খবরগুলো আমার কানে এসেছে। এক নির্বাচনী এলাকা থেকে নিশ্চয়ই একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন একাধিক প্রার্থী চাইতে পারে এবং সেজন্য প্রচারণাতেও নামতে পারে। মনোনয়ন দেয়ার দায়িত্ব দলের মনোনয়নদান কমিটির। এই মনোনয়ন যিনি পাবেন, তাকেই সমর্থন দেয়া হবে তখন অন্য প্রার্থীদের কর্তব্য। তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তা প্রত্যাহার করবেন।

 

রাজবাড়ীর মেহেদী হাসান বলেছেন, জিল্লুল হাকিম আবারও দলের নমিনেশন পেলে আমি তাকেই সমর্থন দেব। কিন্তু আমিও দলের একজন মনোনয়ন প্রার্থী। এ জন্য এলাকায় নিজের প্রচার-প্রচারণা চালাব, যতদিন মনোনয়ন কাকে দেয়া হবে তা স্থির না হয়। তদনুযায়ী তিনি রাজবাড়ীতে দলের মনোনয়ন প্রার্থী হয়ে সভা-সম্মেলন করা শুরু করেন এবং শুরু থেকেই অপর রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নয়, আওয়ামী লীগেরই এক অংশ থেকে হুমকি, হামলা ইত্যাদি পেতে শুরু করেন। মেহেদী হাসানের অভিযোগ, এরা সিটিং এমপির সমর্থক। তাদের হুমকি-ধমকি সম্পর্কে জেলার পুলিশ সুপারের কাছেও অভিযোগ জানিয়ে কোনো সাড়া পাননি।

শেষ পর্যন্ত সপ্তাহ দেড়েক আগে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় সভা করতে যান। এই সভায় হামলার হুমকি দেয়া হয়। স্থানীয় থানার ওসি তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবে যখন তার ওপর হামলা হয়, তখন পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়। তাকে লাঠিপেটা ও ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত করা হয়। তার গাড়িটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার শরীরের ৭ জায়গায় সেলাই দিতে হয় এবং হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয় বেশ কিছুদিন। দলের বৃহত্তর স্বার্থেই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড কি দলের ভেতরেই এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? নইলে এই অভ্যন্তরীণ স্যাবোটাজই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমার নিজের এলাকার (বৃহত্তর বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ) সিটিং এমপি পঙ্কজ দেবনাথ ছাত্রজীবনে একজন দুর্ধর্ষ ছাত্রনেতা ছিলেন। তদুপরি তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে এসেছেন। এজন্য আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাকে পেয়ে গর্বিত ছিলাম। কিন্তু গত দু’বছর এলাকায় গিয়ে তার সম্পর্কে অভিযোগের ফিরিস্তি দেখে আমি স্তম্ভিত। এমনকি তার সম্পর্কে অভিযোগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও। তার অত্যাচারের ভয়ে তারা মুখ খুলে কথা বলতে সাহস পায় না।

আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছি, নদী ভাঙনকবলিত আমাদের এলাকা, শতাব্দী প্রাচীন উলানিয়া করোনেসন হাইস্কুলটি রক্ষার জন্য তাকে সাহায্য জোগাতে। আমি এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে সাহায্য পেয়েছি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও আনিসুল হক আমার সঙ্গে এলাকায় গিয়ে সরেজমিন নদী ভাঙনের অবস্থা দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার সহযোগিতা দিয়েছেন।

 

কিন্তু এই জনপদ, এখানকার ঐতিহাসিক জামে মসজিদ, শতাব্দী প্রাচীন স্কুলটি রক্ষার ব্যাপারে পঙ্কজ দেবনাথের ভূমিকা রহস্যজনক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতিতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধু চরিত্রের ব্যক্তিদের নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন এবং স্থানীয় মানুষের অভাব অভিযোগের দিকে তার নজর খুব কম। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তিনি এলাকায় ‘প্রতাপাদিত্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একই অভিযোগ শুনছি ময়মনসিংহ-১০ এর (গফরগাঁও) সিটিং এমপি ফাহমি গোলন্দাজ সম্পর্কে। তার পিতা আলতাফ গোলন্দাজ একজন নামকরা ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র পিতার সুনাম রক্ষা করতে পারছেন না এই অভিযোগ সত্য হলে দুঃখজনক।

 

আমাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দিয়েছে সিলেট-২ (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ)-এর ঘটনা। এখানে এখন জাতীয় পার্টির এমপি। আগে ছিলেন আওয়ামী লীগের শফিকুর রহমান চৌধুরী, গত সাধারণ নির্বাচনে এরশাদ সাহেব আওয়ামী মহাজোটে আসায় নেত্রীর নির্দেশে এই আসনটি শফিক চৌধুরী জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ইলিয়াস আলীর (বর্তমান নিখোঁজ) মতো দুর্ধর্ষ নেতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আশা করছেন এবার তাকে এ আসনটি ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত ও নিষ্ঠাবান অনুসারী।

এই একই আসনের জন্য মনোনয়ন প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আওয়ামী লীগের লন্ডন-রাজনীতিতে তিনি ছিলেন শফিক চৌধুরীর শিষ্য। বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক। খুবই কর্মঠ যুবক এবং অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী। আগামী নির্বাচনে তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে, তারা মনোনয়ন লাভের প্রচারণায় নেমে একে অন্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের ঝড় তুলেছেন, তাতে গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের।

আমি অযাচিত হয়ে তাদের পরামর্শ দিয়েছিলাম, আপনারা আপনাদের প্রচার-প্রচারণার টার্গেট করুন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীকে। একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করবেন না। আপনাদের বর্তমান প্রচার-প্রোপাগান্ডায় সাধারণ ভোটদাতারা আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ হতে পারে। তখন ভোট চলে যেতে পারে বিএনপির ভোট বাক্সে। আপনারা সভায় দাঁড়িয়ে বলুন আওয়ামী লীগ এই কেন্দ্রে আপনাদের যাকে নমিনেশন দেবে, তাকেই আপনি সমর্থন দেবেন।

 

বিএনপি-জোট এবার নির্বাচনে আসছে। সিলেট-২-এর এই কেন্দ্রে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। বাজারে গুজব, তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, ইলিয়াস আলীর অকস্মাৎ গুম হওয়াও তার অন্যতম কারণ। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত থাকলে বিএনপি-প্রার্থীর অনায়াস জয় সম্ভব হতে পারে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের বহু আগে উচিত ছিল সিলেটে এই দুই মনোনয়ন-প্রার্থীর সম্মুখ সমর বন্ধ করা। তারা মনোনয়নের জন্য সভা-সমিতি করুন। কিন্তু নিজেরা যেন পরস্পরকে ভোটদাতাদের কাছে উলঙ্গ না করেন।

 

এবারের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনদের মতো নেতাদের নেতৃত্বে একশ’টা ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলেও আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আমার ভয়, আওয়ামী লীগের ঘরের বিভীষণদের নিয়ে। মনোনয়ন পাওয়ার আগেই তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও সন্ত্রাস শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে দুটি প্রাণহানিও ঘটেছে। এরপর মনোনয়ন যারা পাবেন না তারা তখন কী করবেন? বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কত দাঁড়াবে তা ভেবে আমি শঙ্কিত।

সিটিং এমপিদের মধ্যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত এক বিরাট সংখ্যক ব্যক্তি (দু-একজনের নাম উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে উল্লেখ করেছি) আবার মনোনয়ন লাভ থেকে বঞ্চিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস, শেখ হাসিনা সেই আশ্বাসই দেশের মানুষকে দিয়েছেন। মনোনয়ন না পেলে এরাও যাতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়াতে না পারে, সেদিকেও আওয়ামী লীগকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।

 

‘আওয়ামী লীগের আসল শত্রু আওয়ামী লীগই’- এই কথাটার প্রচলন হয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অবস্থা থেকেই। এই অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। শেখ হাসিনা কঠোর হয়েছেন। তার সঙ্গে যে মনোনয়নদানের কমিটি রয়েছে, তাদেরও কঠোর হতে হবে। নতুন, পুরনো সব মনোনয়ন প্রার্থীরই অতীত ও বর্তমান ভালোভাবে স্ক্রিনিং করে সৎ, যোগ্য ও জনগণের পছন্দের মানুষকে মনোনয়ন দিতে হবে। যত বেশি ৪০-৪৫ বছরের অনূর্ধ্ব শিক্ষিত ও সৎ ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য করে আনা যাবে ততই দেশের মঙ্গল, আওয়ামী লীগের মঙ্গল।

 

এই নির্বাচনই হয়তো আমার এই জীবনে দেখা শেষ নির্বাচন। বিদায় নেয়ার আগে তাই প্রার্থনা করি, এই নির্বাচনে যেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত একটি সৎ, শিক্ষিত, কর্মঠ, দেশপ্রেমিক সরকার দেখে যেতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *