ভাবনার পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে মাঝে মাঝে বসে থাকি নিরবে। বাকহীন মৌনী সময়ে মনের ঘরে ভিড় জমায় বাকমুখর স্মৃতিরা। স্বাধীনতার পর আজ সময়ের সূতোটা কতটা দীর্ঘ সময় গড়ালো! জীবনের কত চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনায় হারালো।সন্তান হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন আমার প্রিয় বাবা-মা ও। আফসোস এই দীর্ঘ সময়ে শহীদের জনক-জননী হিসেবে ন্যুনতম সম্মান তারা পাননি।
সেকেন্ড,মিনিটের যাঁতাকলে পিষে সময়কে ব্যবচ্ছেদ করতে আজ আর ইচ্ছে করে না। বুকের মাঝে অভিমানী কান্নার ঢেউ,স্বজন হারানোর বেদনা বিদুর স্মৃতি আদিগন্ত ব্যাথার প্রস্রবনে আমাকে আপ্লুত রাখে সারাবেলা।স্বাধীনতা দিসব,বিজয় দিবস কিংবা ভাষা দিবসে শহীদদের স্মরণ জাতিকে আবেগের বন্যায় ভাসায় মাঝে মাঝে। কিন্তু আমরা যারা নিজেদের প্রিয়জনের অমূল্য জীবন বলিদানের মধ্য দিয়ে মা,মাটি আর মানুষের জন্য স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য ছিনিয়ে এনেছি তারা কাঁদি সব সময়। আমাদের উদগত অশ্রু বাষ্প হয়ে আটকে থাকে গলার কাছে সবসময়ই।
হ্যাঁ আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আবসারের ছোট ভাই লিখছি।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ইন্ডিয়া হতে সসস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে আসা ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার প্রথম প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আবসার। দেশের বিপন্ন স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে স্বজন প্রিয়জনের পিছুটান উপেক্ষা করে যে যুবক নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেরিয়েছেন পাকহানাদারদের পিছু ধাওয়া করে।পরিণামে স্বাধীনতার মাত্র ৫ দিন আগে প্রাণপ্রিয় জীবনকে পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়ে ঠাঁই করে নিলেন রক্তিম সূর্যের বুকের মাঝখানটায়।
না, জাগতিক কোন বিনিময় আমরা চাইনি। শুধু পরিবারের পক্ষ হতে চেয়েছিলাম ভাইয়ের এদেশীয় খুনীদের বিচার। কিন্তু স্বাধীনতার পর আজ এতটা বেলা গড়ালো,অপেক্ষায় কত উদগ্রীব সময় কেটে গেল।অথচ সেই অপ্রাপ্তি যে অপ্রাপ্তির মোড়কেই ঢেকে রইলো।
পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের বদৌলতে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে পাকিস্থানী আর্মি হানা দিত। বাজখাই গলায় প্রশ্ন করতো- ইয়ে মুক্তিকা ঘর হ্যায়? ব্যস এরপর পাকিস্থানী হানাদারদের ক্রোধ জ্বলসে উঠতো। আর আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে থাকতো সমস্ত বাড়িঘর। ঠিক এমনি এক ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে আতংকিত পরিবারের সদস্যরা পালাতে গিয়ে আমাকে ফেলে গেল পরিত্যক্ত বাড়ির উঠোনে। হানাদার বাহিনী তাদের ক্রোধ চরিতার্থ করতে কাউকে না পেয়ে রাইফেল তাক করলো আমার বুকের উপর-ইয়ে মুক্তিকা ভাই হ্যায়? ছোট্র শিশু আমি নির্বিকার। আপন মনে খেলছি। তখন এক ভিখারীনি সাহসিকতার সাথে এগিয়ে এসে বললো- না, না। এ মুক্তিযোদ্ধা আবসারের কেউ না। এতো আমার বাচ্ছা। এমনি করে সেদিন এক নিরিহ ভিখারীনির মিথ্যার বদৌলতে প্রাণে বেঁচে গেলাম আমি।
বলতে পারেন সম্মানিত পাঠক, কেন সেদিন বিধাতা বাঁচিয়ে রাখলেন আমায়? স্বাধীনতা পরবর্তী এত দীর্ঘ সময় ধরে স্বজন হারানোর ব্যাথা বইবার জন্যই কি? একজন জাতীয় বীরের প্রতি দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অবিচার আর অবহেলা দেখার জন্যই কি? কিংবা অপ্রাপ্তির লজ্জা নিয়ে আজকের এ লিখার জন্য কলম ধরবো বলেই কি? কত যে অগণিত প্রশ্নে ভারী হয়ে আছে এই মন।
বড় আপার কাছে শুনেছি, খুব ছোটবেলা আমি যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাড়ির কাচারি ঘরের টিনের বেড়ায় আমার ছোট দুটি হাত দিয়ে শব্দ করতাম তখন আমার বড় ভাই নুরুল আবসার কাচারি ঘর হতে পড়া ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন- শেখু,ছোট ভাইয়া তুমি এমন সময় পৃথিবীতে এলে যখন সোনার দেশটা শকুনির নজরে পড়ে ক্ষত বিক্ষত হতে চলেছে। আপাকে আকুলতা নিয়ে প্রশ্ন করতেন- বুবু ওরা বাংলায় কথা বলতে পারবে তো?
আমার ভাবতে অবাক লাগে বুকের মাঝে ভালোবাসার কতটা গভীরতায় দেশকে রাখতে পারলে এক তরুণ তার চিন্তা চেতনায় দেশের প্রতি এতটা প্রগাঢ় আর অকৃত্রিম অনুভব লালন করতে পারে। এতটা স্বপ্নাতুরের মত জীবনের সব ভয় ডর উপেক্ষা করে দেশের টানে ছুটে যেতে পারে।
আমার নিজের তারুণ্যের দিনগুলোয় বড় ভাই শহীদ নুরুল আবসারের প্রতি অবহেলা দেখে বুকের মাঝে ক্ষোভের অতলান্ত সাগর উথলে উঠতো।আমার ভাইয়ের খুনীদের নিঃসংকোচে চারদিকে ঘুরে বেড়াতে দেখে জেদ আর উত্তেজনার বশে মনে হত আমরা যখন আইনের দারস্থ হয়ে ও কোন আইনী সহযোগিতা পেলাম না। তাহলে আইন হাতে তুলে নেব। রক্তের মাঝে প্রতিশোধের এক কাঁপন অনুভব করতাম।বুকের মাঝে অদৃশ্য এক রক্ত ক্ষরণ হত। নিজকে বঞ্চিত আর অবহেলিত মনে হত।
কিন্ত পরক্ষণেই নিজকে শান্ত করতাম পারিবারিক শিক্ষা আর ঐতিহ্যের কথা ভেবে। আমার বাবা-মা যে আমাদেরকে ত্যাগের শিক্ষাই দিয়েছেন আজীবন। যার সর্বোচ্চ ইতিহাস রচে গেলেন আমার বড় ভাই কমান্ডার নুরুল আবসার জীবন দিয়ে। শহীদের ত্যাগের সেই পথের রেখা হতে কি করে নিজকে বিছিন্ন করি?
নাইবা পেলাম একজন জাতীয় বীরের খুনীদের বিচার আর নাইবা পেলাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাইয়ের ন্যুনতম স্বীকৃতি। তাইতো রাষ্ট্রীয় অযতন আর অবহেলায় আমাদের পরিবারের এই বেদনা মাখা আত্নদানের স্মৃতি যাতে মুছে না যায় সেজন্য আমি নিজস্ব উদ্যেগে আমাদের বাড়ির গেইটে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করে নামকরণ করিয়েছি-‘’শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আবসারের বাড়ি’’।
বর্তমানের কাছে হয়তো অবহেলা আর অযতনে ধামাচাপা পড়ে রয়েছে এক জাতীয় বীরের ইতিহাস। কিন্তু বুকের মাঝে ক্ষীণ আশা কোন এক ক্লান্ত পথিকের দৃষ্টি খানিকের তরে হলে ও যদি আছড়ে পড়ে বাড়ির এই নামফলকে। যদিবা অনাগত ভবিষ্যতে কোন এক নতুন প্রজন্ম কৌতুহলী হয়ে এসে দাঁড়ায় এই বাড়ির নামফলকের সামনে। জানতে চায় এক অবহেলিত শহীদের রক্তমাখা ইতিহাস।
সময়ের প্ররিক্রমায় একাত্তরের সেদিনের সেই শিশু আমি আজ দু’সন্তানের জনক। পারিবারিক ঐতিহ্যের পথ ধরেই নিজের দু’সন্তানের নাম রেখেছি-জয় এবং বিজয়।
কিন্তু বাবা হিসেবে নিজের মাঝে অক্ষমতার গ্লানি আমাকে নিরবে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তীব্র বিষাদে ভরে যায় মন। যখন ভাবি কি জবাব দেব নিজের আন্তজদের যখন তারা নিজ বাড়ির নামফলকের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই প্রশ্ন করবে- বাবা, কোন অপরাধে বিচার পেলেন না একজন জাতীয় বীর?
বলতে পারেন আপনারা কি জবাব দেব আমি আমার সন্তানদের ?
লেখক, শহীদ নুরুল অাফছার এর ছোট ভাই।