চট্টগ্রাম ব্যুরো ।। কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণে ও পাহড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হয়েছে। এতে চকরিয়া পৌর শহর সহ বিভিন্ন ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বানের পানির স্রােত মাতামুহুরী ব্রিজ পয়েন্টে বিপদ সীমার ২-৩ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বানের পানি চকরিয়ার একাধিক ইউনিয়নের সড়কের উপর উপচে পড়ায় চিরিঙ্গা শহরের সাথে অভ্যন্তরীন সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে পানি সহজে সরে যেতে না পেরে ও বানের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় উপজেলার অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, লাগাতার ভরি বর্ষণে চকরিয়া পৌরসভার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চকরিয়া পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের আমাইন্যাচর, কাজির পাড়া,২নং ওয়ার্ডের জেলে পাড়া, হালকাকারা, মৌলভীর চর, ৩নং ওয়ার্ডের তরছ পাড়া, ও ৮নং ওর্য়াডের নামার চিরিংগা, কোচ পাড়া, ও ৯নং ওয়ার্ডের মৌলভীর কুম সহ অনেক স্থানে বাড়ি-ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক পরিবার রান্না বান্নার কাজ সারতে গিয়ে তাদের হিমশীম হেতে হচ্ছে। শতশত মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। পৌর ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুজিবুল হক জানান, ভারিবর্ষণে লামার চিরিংগা গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। কোচপাড়া ও মাষ্টারপাড়ার একাধিক বাড়ি-ঘরে বন্যার পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও পৌরশহরের গুরুত্বপূর্ন সড়ক গুলোতে যান চলাচল করতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। কোচ পাড়া এলাকায় ১ নং পৌর শহর রক্ষা বাধঁটি ঝুকির মধ্যে রয়েছে। সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানান, ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি মাতামুহুরী নদীতে বাড়ার সাথে সাথে তার ইউনিয়নের উত্তর মানিকপুর ও দক্ষিণ সুরাজপুর গ্রামের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে অন্তত শতাধিক পরিবার।বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার জানান, তার ইউনিয়নের ডেইঙ্গাকাটা, রসুলাবাদ, হিন্দুপাড়া, বিবিরখিল, গোবিন্দপুর, দক্ষিণপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কয়েকটি গ্রামের মানুষ বর্তমানে নৌকায় করে চলাচল করছে। মাতামুহুরী নদী, হারবাং ছড়া ও সোনাইছড়ি খালের পানিতে এই অবস্থা হয়েছে বলে তিনি জানান।কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান জানান, দুইদিনের ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি হু হু করে বাড়ছে মাতামুহুরী নদীতে। ভারি বর্ষণ আরো কয়েকদিন স্থায়ী হলেই ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে। তবে এখনো (গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত) মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও ঢলের পানি নদীর দুইতীর উপচে পড়ার মতো উপক্রম হয়েছে।চকরিয়া উপজেলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুদ্দিন মোঃ শিবলী নোমান জানান, উপজেলার বরইতলী ও কাকারা ইউনিয়ন পরিদর্শন করে দেখা গেছে দুই ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যা প্লাবিত হয়েছে। বরইতলী ইউনিয়নের ডেইঙ্গা কাটা এরাকায় বন্যার পানি বাড়ি ঘরে ছুই ছুই অবস্থা। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এ দুইটি ইউনিয়নে বন্যার পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে আগামী ২-৩ দিন অত্র এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধস ও নদী ভাঙ্গনের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। চকরিয়া উপজেলায় ১৮ ইউনিয়নের মধ্যে হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, বিএমচর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, ডুলাহজারা, ও খুটাখালি ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত জনসাধারণকে বন্যা, পাহাড় ধস ও ভাঙ্গন মোকাবেলায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে। তাই সম্ভাব্য ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে জানমাল বাঁচাতে সবকটি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সতর্ক করা হয়েছে।চকরিয়া-মহেশখালী সড়কের বাটাখালী অংশে বন্যার পনিতে সড়ক ডুবে যাওয়ায় গতকাল এ সড়কে যানবাহন চলাচল করেনি। চিরিঙ্গা-মগনামা সড়কের পহরচাঁদা থেকে চড়াপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার সড়ক পানিতে ডুবে যায়। জিদ্দাবাজার-মানিকপুর সড়কও ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান জানান,চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর তীরের কন্যারকুম, কইজ্যারদিয়া, পুরুত্যাখালী এলাকার বেড়িবাঁধের কিছু অংশ চরম ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকাও আছে। এদিকে বান্দরবানে গত কয়েকদিন ধরে টানা বর্ষণে দেখা দিয়েছে বন্যা ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ধসে পড়েছে পাহাড়ের মাটি। এর ফলে বন্ধ রয়েছে জেলা শহরের সাথে বিভিন্ন উপজেলার আন্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এদিকে টানা বর্ষনের ফলে সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে অতিবাহিত হওয়ায় বালাঘাটার স্বর্ণ মন্দির এলাকায় পুল পাড়ার বেইলী সেতু পানিতে ডুবে যাওয়ায় বান্দরবানের সাথে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও লামা উপজেলায় বিভিন্ন এলাকা এবং বান্দরবান শহরের বেশ কয়েকটি নি¤œাঞ্চল আর্মিপাড়া, ইসলামপুর, শেরে বাংলা নগর, ওয়াপদাব্রীজ ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।এদিকে অব্যাহত বর্ষণের ফলে পাহাড়ে ঝুকিঁ পূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। তাদের কে স্ব স্ব এলাকার সরকারী বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টির কারনে বন্যা ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে তাই পাহাড়ে ঝুকিঁ পূর্ণ বসবাসকারীদের সরকারী বিদ্যালয় গুলোতে আশ্রয় নেয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। যে কোন দূর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী মজুদ রয়েছে,আশ্রয় কেন্দ্র গুলোও প্রস্তুত রাখা হয়েছে তবে প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে আমরা সবচেয়ে বেশী জোড় দিচ্ছি। এলাকাবাসীরা জানান,বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলরায় প্রায় ১৫ হাজার পরিবার,রাংগামাটি জেলার ১০টি উপজেলায় প্রায় ৩০হাজার পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের বসতি রয়েছে উঁচু-নিচু পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশেই। এসব পরিবার যুগ-যুগ ধরেই বসবাস করলেও জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বর্ষায় কেবল মাইকিং করে কথিত নিরাপদস্থানে সরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করা ছাড়া বাস্তবমুখি কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনিপার্বত্য তিন জেলায় দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর উদ্যোগে অঢেল অর্থ ব্যয় দেখানো হয় ফি বছরই কথিত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ-ট্রশিক্ষণসহ উদ্বুদ্ধকরণ কাজে। যেখানে মাথাগোজার ঠাইটুকুও নেই কিংবা সুযোগ বঞ্চিত সাধারণ মানুষ সেখানে আবার কথিত উন্নয়ন নিয়ে মহা ভাবনায় মেতে থাকেন পাহাড়ের জনপ্রতিনিধি ও সমাজনেতারা, ইহা খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাস্করও বটে- এসব মন্তব্য ভুমি অধিকার বঞ্চিত ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান বিভিন্ন চুক্তি, ইস্যু ও স্থানীয় রাজনীতিকদের চাপিয়ে দেয়া ক্ষমতার দখল। ইউনিয়ন,উপজেলা বা পৌরসভা ভিত্তিক পাহাড়ে ঝূঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদস্থানে পুনর্বাসন করার কোন সরকারি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি এখনও। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় তিন পার্বত্য জেলায় কমপক্ষে শতাধিক মানুষের অকালে মৃত্যু ঘটে। এদিকে সদর উপজেলার কাসেমপাড়া, ইসলামপুর, বনরূপা পাড়া, হাফেজঘোনা, বাসস্টেশন এলাকা, স্টেডিয়াম এলাকা, নোয়াপাড়া, কসাইপাড়াসহ লামা আলীকদম, নাইক্ষংছড়ি,রোয়াংছড়ি,থানছিও রুমা উপজেলা প্রায় ১৫ হাজারের বেশি পরিবার রয়েছে।
ভারি বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : বান্দরবন-রাঙ্গামাটি সড়ক বিচ্ছিন্ন
