প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং দুই দেশের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন

নিউজ ডেস্ক :

প্রায় দুই দশক আগেকার স্মৃতি ফিরিয়ে এনে শুক্রবার (২৫ মে) আরও একবার রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনে পা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার শেখ হাসিনা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। বছর ২০ আগে এই শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ই তাকে তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল, আর এবার সেই ক্যাম্পাসেই তিনি উদ্বোধন করেন ‘বাংলাদেশ ভবনের’।

বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের শুরুতে ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ভাষণে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পদ্মা মেঘনা যমুনার মতো, অবিরল অবিচল। এই সম্পর্ক অনেকদূর গড়াবে।’

বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ ভবনের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই ভবনটি একসময় তীর্থস্থানে পরিণত হবে। দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বিশ্বভারতী কাজ করেছে। আমরা ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু ভবন করতে চাই।’ তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সবাইকে রমজান ও ঈদের শুভেচ্ছা জানান।

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ছিটমহল বিনিময় করেছি। ভবিষ্যতেও যেকোনও সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সমাধান করতে পারবো। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানান ভারতের প্রতি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটা মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরাই আমার লক্ষ্য। ভারতের মতো বন্ধু দেশ পাশে আছে। তাই মনে করি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বভারতী বিশ্বদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পুরনো। তারা আমাকে সম্মানিত করেছে। আমি মনে করি এটা আমারও বিশ্ববিদ্যালয়।’ বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ভবন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দোপাধ্যায়সহ দুই বাংলার সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। কবিগুরুর হাতে গড়া শান্তিনিকেতন। তিনি আমাদেরও। দুই দেশের জাতীয় সংগীত তিনি লিখেছেন। তার বেশিরভাগ কবিতাই বাংলাদেশে বসে লেখা। তাই আমাদের অধিকার বেশি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই অবদান আমরা ভুলবো না। এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, আমাদের দুই দেশের যোদ্ধাদের রক্ত মিশে গেছে। স্বাধীনতার পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। স্থল সীমান্ত চুক্তি। ভারতের সবাই দল-মত নির্বিশেষে এক হয়ে বিলটি পাস করে দিলো। দুই দেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ছিটমহল বিনিময় করেছি। এটা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত। উৎসমুখর পরিবেশে এই বিনিময় হয়েছে। এজন্য সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন। ভবিষ্যতে যেকোনও সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সমাধান করতে পারবো।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাদের শত্রু একটাই, দারিদ্র্য। আমাদের এই অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত ও ক্ষুধামুক্ত করতে চাই। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। সবাই মিলে কাজ করে এই অঞ্চলে কিছু করবো।’

তিনি আরো যোগ করেন, ‘রেহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশ। তারপরও আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। তবে সহযোগিতা চাই, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারকে চাপ অব্যাহত থাকুক।’

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যের শুরুতে তিনি বাংলায় বলেন, ‘সকলকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। শান্তির নীড় কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে আমি অত্যন্ত আনন্দ ও শান্তি অনুভব করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ, কিন্তু আমাদের স্বার্থগত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে হোক কিংবা সরকারি নীতির দিক দিয়ে হোক, আমরা এক অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। বাংলাদেশ ভবন তেমনই একটি দৃষ্টান্ত।’

সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভবন-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই ভবনে রয়েছে আধুনিক থিয়েটার, প্রদর্শনী কক্ষ, বিশাল লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কিত গ্রন্থ। এছাড়া, ভবনের প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুর্যাল স্থাপন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে বাংলাদেশের জন্যে তাৎপর্যময় রাজনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়। বাংলদেশের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাফল্যের এ ধারা বজায় রাখতে পরামর্শ দেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী জানান, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি সচেতন আছেন এবং আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের যে কোন প্রয়োজনে ভারত সরকার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে ব্যক্তিগত আলাপকালে মোদী বলেন, ‘ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে দু দেশের একসঙ্গে কাজ করা দরকার, আর বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশীদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা প্রয়োজন।‘ আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকারকে জয়যুক্ত করতে আন্তর্জাতিকভাবে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করার আশ্বাসও দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সফরসূচির অংশ হিসেবে শনিবার আসানসোলে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সমাবর্তনে শেখ হাসিনাকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের পর মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বর্ণ পদক প্রদান করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *