চট্টগ্রাম: ভবনটির আসল নামই পালটে গেছে। পালটে গেছে ভবন মালিকের নামটাও। গতকাল জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত খুলশী থানাধীন হাবিব লেনের ওই বাড়িটিতে অভিযান চালিয়ে পিলে চমকানো এ তথ্য পায়। জানা যায়, ভবনটি এখন ‘ইয়াবা গেস্ট হাউজ’ নামে পরিচিত। আর গেস্ট হাউজের মালিক হলেন সদরঘাট থানার বহিষ্কৃত ওসি মাইনুল ইসলাম। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বে দুপুর দুই টায় পরিচালিত অভিযানে এ গেস্ট হাউজ থেকে চার বোতল ভতকা, বিশ পিস ইয়াবা, ইয়াবা ও সীসা সেবনের সরঞ্জাম এবং এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার নয়শত নব্বই টাকা উদ্ধার করা হয়। ইয়াবা ব্যবসা, সেবন ও অসামাজিক কার্যক্রম চালানোর জন্য পনের জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। জব্দকৃত মালামাল ধ্বংস করা হয়েছে ও অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে অপরাধে সহাযতা করছে পুলিশ এমন অভিযোগ অভিজাত এলাকাবাসীর। নগরীর বিলাসবহুল এলাকা হিসেবে খ্যাত খুলশী আবাসিক এলাকায় পুলিশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে স্থানীয়দের। খুলশী থানা পুলিশের মোবাইল টিম ওই এলাকায় থাকা ১৫টিরও বেশি রেস্ট হাউসকে ঘিরে প্রতিনিয়ত অর্থ আদায়ের অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে বলে স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলকে অভিযোগ করলেও এর কোন মনিটরিং নেই। খুলশী আবাসিক এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ি, আবাসিক ভবন এবং গেস্টহাউস নামের অতিথিশালায় পুলিশকে ম্যানেজ করেই মাদক ও দেহ ব্যবসা চলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর এতে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরাও। ফলে খুলশী এলাকায় নির্বিঘ্নে চলছে কলগার্ল আর মাদকের বাণিজ্য। শুধু তাই নয়, এমন অভিযোগও আছে যে খুলশী থানায় বদলি হওয়ার জন্য পুলিশ সদস্যদের তদবির চলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ওপর মহলে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, জেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় নাগরিক আবেদন থেকে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে তথ্য প্রদানকারী ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টরবৃন্দ ও নবম এপিবিএন এর সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অত্যন্ত গোপণীয়তার সাথে গতকাল দুপুর দুইটার দিকে ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারের পাশের গলি হাবিব লেনের শেষ মাথায় পাচ তলা এক বিল্ডিংয়ে অভিযান চালানো হয়। ওই বিল্ডিংয়েই গড়ে তোলা হয়েছে ইয়ারা গেস্ট হাউজ। নিচতলায় অফিস, দুই থেকে পাচ তলায় বিভিন্ন রুমে চলে দেহ ব্যবসা। অভিযানে প্রতি রুমে পাওয়া যায় ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম। নিচ তলার এক লকার থেকে চার বোতল ভতকা ও একটি কেবিনেট ভাঙ্গা হলে সেখান থেকে এক লক্ষ নয়শত নব্বই টাকা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বিভিন্ন সময় এ হোটেলে আসা ব্যক্তিদের তালিকা। কল গার্লের তালিকা, বিভিন্ন তারিখে তাদের দেওয়া টাকা ও টোকেন। হোটেলের মেয়েদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রতি পুরুষের কাছ থেকে হোটেলের মালিক এক হাজার টাকা করে নেয়, আর মেয়েদের দেয়া হয় ৫০০ টাকা করে। জীবনের তাগিদে তারা এ রাচ্চায় এসেছেন। তাদের কেউ ঢাকা থেকে আসেন, কেউ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। প্রাথমিকভাবে আটক হওয়া এগারজন মেয়ের বয়স ২০ থেকে ২৬ বছর পর্যন্ত। পরবর্তীতে মানবিক বিবেচনায় সতর্ক করে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
আদালত জানতে পারেন, সন্দ্বীপের মকদারা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ববি এ ব্যবসার সাথে জড়িত। তার পকেট থেকে তার ভাগের চুয়াল্লিশ হাজার টাকা পাওয়া যায়। দালাল মো. মাসুম ও দালাল জাহাঙ্গীরকে ছয় মাস, পারভেজকে এক মাস, মো. ইউসুফ, মানিক ও বাহার আমজাদ, জাকারিয়া শাহাবুদ্দিনি, ইমরানকে পনের দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত। বাবুর্চি তাহের (৬২), তার সহকারী নিত্য বড়ুয়া (৫৮)কে মানবিক ও বয়স বিবেচনায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দারোয়ান বাশারকে (৩৫) একমাসের, নোয়াখালীর আলমগীর (৪৮), কক্সবাজারের গণি হোটেলের ম্যানেজার আলম ও বাবুল মোবাইল কোর্টের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়।
প্রসঙ্গত: ইতোপূর্বে একাধিকবার এই এলাকার বিভিন্ন রেস্ট হাউজে অভিযান চালানো হলেও ‘ওপর মহলের’ চাপে শেষ পর্যন্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন অভিযান টিমের সদস্যরা। ফলে দ্বিগুণ উৎসাহে চলতে শুরু করে অসামাজিক কার্যকলাপ ও মাদক ব্যবসা। গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিলাসবহুল ভবনে গড়ে উঠা রেস্ট হাউসের মধ্যে আরো রয়েছে উত্তর খুলশীর ১ নং রোডে খুলশী গেস্ট হাউস, ২ নং রোডে হিলটপ ও লেকভিউ, ৩ নং রোডে নাইটসেডো, ৪ নং রোডে সেঞ্চুরী পার্ক ও ইডেন পার্ক, ৫নং রোডে রিয়েল পার্ক, ৬নং রোডে গ্রীন রেসিডেন্ট ও সিলভার স্পুন, দক্ষিণ খুলশীতে হিলটপ ইন, ৪নং রোডে ব্লু–ওয়াটার ইন, রেখা হাউস–১, রেখা হাউস–২, স্বপ্ন বিলাসসহ ১৫টিরও বেশি স্পট। এ ধরনের একটি তালিকাও গোয়েন্দা বিভাগ তৈরি করেছে।