মাদক সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে পুলিশের কেউ ছাড় পাবে না – আইজিপি 

বিশেষ সাক্ষাতকার :

ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী , বিপিএম (বার) চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর থানাধীন মান্দারী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ষষ্ঠ বিসিএসে (১৯৮৪) পুলিশ ক্যাডারে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন।

চাঁদপুরের এই সন্তান নিজ জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ৩২ বছরের গৌরবোজ্জ্বল কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, পেশাদারি ও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত  সাক্ষাৎকার।

প্রতিবেদক : শুরুতেই আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। নতুন দায়িত্বে আপনার চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

জাবেদ পাটোয়ারী : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে কালের কণ্ঠ কর্তৃপক্ষ ও পত্রিকার অগণিত পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী যাঁরা আছেন সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। দেখুন, প্রতিটি দিন পুলিশের একেকটি চ্যালেঞ্জ।

আমি যেদিন আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সেদিনই আমি বলেছি, আমাদের চাকরি ভিন্ন ধরনের। অন্য যেকোনো পেশার তুলনায় এ চাকরির নেচারটাই আলাদা। এখানে প্রতিদিনই কিন্তু একেকটি চ্যালেঞ্জিং দিন। আপনি নিজেও প্রেডিক্ট করতে পারেন, আগামী দিন আপনার জন্য কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং আপনাকে কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং প্রতিদিনই কিন্তু আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আপনারা দেখবেন, পুলিশের কোনো সদস্যই অন্য পেশার মতো ৯টা-৫টা অফিস করতে পারে না। তাদের সাত দিনের হিসাব যদি নেন, দেখবেন যে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিদিনই কাজের প্রকৃতি, ধরন ও চ্যালেঞ্জগুলো ভিন্ন। সুতরাং আমি মনে করি, আমাদের প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা পুলিশে যোগদান করেছি।

প্রতিবেদক : প্রায়ই দেখা যায়, গরিবরা পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। গরিবের জন্য পুলিশিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

জাবেদ পাটোয়ারী : ধন্যবাদ। জনগণের কাছে যদি পুলিশ আস্থার বাহিনী হিসেবে পরিগণিত হয়, তাহলে যে কেউ পুলিশের কাছে আসতে পারে। আপনি যে ভীতির কথা, উৎকণ্ঠা ও বাধার কথা বলছেন, তখন তা আর থাকবে না। মানুষ মনে করবে পুলিশের দ্বার সবার জন্য খোলা রয়েছে। যে কথাটা বলা হয়, পুলিশ জনগণের বন্ধু। প্রকৃতির অর্থেই আপনি যদি দেখেন সাধারণ মানুষ যখন কেউ বিপদে পড়ে তখন অবশ্যই প্রথমে স্রষ্টার কথা মনে করে। পরবর্তী সময়ে কোনো অপরাধের প্রতিকারের জন্য তাকে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হয়। আমরা ওই জায়গাতেই যেতে চাই, যেখানে মানুষ সাবলীলভাবে পুলিশের কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। সে যে-ই হোক বা সমাজের যে স্তরের হোক না কেন, তারা পুলিশের কাছে আসবেই।

প্রতিবেদক : থানা হচ্ছে পুলিশের আয়না। একটি থানা থেকেই পুলিশের আসল পরিচয় পাওয়া যাবে। একটি কথা সব সময় আলোচনায় থাকে, তা হচ্ছে আমাদের থানাগুলো জনবান্ধব নয়। থানাগুলো আরো জনবান্ধব করতে আপনি কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

জাবেদ পাটোয়ারী : আপনি যেভাবে বলছেন, কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। থানাকে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের আস্থার জায়গায় নিয়ে আসার জন্য নিকট-অতীতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমি আগেও বলেছি, মানুষের মনে যে আস্থার জায়গাটি আছে এটি গ্রহণ করতে হলে আমাকেই এগিয়ে আসতে হবে। পুলিশকে এগিয়ে যেতে হবে। মানুষের মনে এ ধারণার জন্ম দিতে হবে, পুলিশ আপনার পাশে সব সময় আছে। আপনি যেকোনো বিপদে পড়লে পুলিশকে চাইলেই পাবেন। আমরা আপনার মতো বিশ্বাস করি, থানাকে ঘিরেই কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা বেশি। যাঁরা পুলিশের কাছে আসেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ লোক থানাতেই আসেন। সুতরাং থানাকে ঘিরেই সেবাপ্রত্যাশীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। তাঁরা বোঝেন থানায় গেলেই বুঝি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি যে জায়গাটাতে কাজ করতে চাই তা হলো মাইন্ডসেটের জায়গাটুকু। নিরীহ ও নিরপরাধ লোকজনের পাশে থাকতে চাই। পুলিশকে ফিল করতে হবে, এ জনগণের জন্যই আমরা। এ জনগণের ট্যাক্সের টাকায়ই আমাদের বেতন হয়। সুতরাং তাদের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়াটা আমার সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। আমি যখন এ জায়গাটাতে কাজ করতে পারব, পুলিশের যারা আছে তারা যখন মোটিভেটেড হবে, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে।

প্রতিবেদক : মাদক প্রতিরোধে পুলিশ কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? সাধারণ মানুষের ধারণা, পুলিশ ইচ্ছা করলে মাদক কারবার ও চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। বর্তমান পুলিশের সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা আছে। অভাব শুধু সদিচ্ছার।

জাবেদ পাটোয়ারী : আপনি সাধারণ মানুষের পারসেপশনের কথা বলেছেন। ধারণার কথা বলেছেন। আমি এখানেও বলতে চাই, মাদক শুধু পুলিশের সমস্যা বললে কিন্তু বোঝা যাবে না। মাদক নিয়ে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তা একটি সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে সামাজিকভাবেই। মাদক উৎপাদন, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন, বিক্রি, যারা সেবন করছে তাদের নিরাময় করা এবং পরবর্তী সময়ে তাদের পুনর্বাসিত করা। আপনি যদি মাদক সমস্যাকে অ্যাড্রেস করতে চান, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটাকেই অ্যাড্রেস করতে হবে। দেখুন, পুরো সমস্যাটি কিন্তু পুলিশের সমস্যা নয়। সুতরাং যারা এর স্টেকহোল্ডার আছে, যারা কনসার্ন—সবারই অংশগ্রহণ লাগবে। এখানে ধরুন শেষের পর্যায়ে আসি, আপনার মনস্তাত্ত্বিক, ডক্টর ও সাইকিয়াট্রিস্ট লাগবে, মানুষকে সুস্থ করে তোলার জন্য সোশ্যাল ওয়ার্কার লাগবে, আপনি রিহ্যাবিলিটেট করার জন্য, তারপর ধরুন সবাইকে সম্পৃক্ত করা, সমস্যা সমাধান ও আপনার প্রতিটি স্তরে আপনাকে কাজ করতে হবে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই সমস্যা সম্পর্কে যদি আপনি সবার পার্টিসিপিশন চান, স্কুল-কলেজের ছাত্র, যারা মাত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে গেছে বা কৈশোরে আছে, তারা যাতে মাদকাসক্ত না হয় সে জন্য তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সমাজে নেতৃস্থানীয় যাঁরা আছেন এখানে পলিটিশিয়ান, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের যাঁরা আছেন, তাঁদের দায়িত্ব আছে। তারপর ধর্মীয় নেতারা আছেন, তাঁদের কাজে লাগাতে হবে। আপনি যদি তাঁদের উদ্বুব্ধ করতে না পারেন বা সমাজকে উদ্বুব্ধ করতে না পারেন, তাহলে কিন্তু কাজ হবে না। শুধু আমরা কোথাও অপারেশনে যাব, কিছু মাদক উদ্ধার করব। কিন্তু চাহিদা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ জোগান আসতেই থাকবে। এটি ইকোনমিকসের থিওরি। এখন আপনাকে চাহিদা কমাতে হবে, যারা অলরেডি মাদকসেবী হয়ে গেছে, এদের নিরাময় করে পুনর্বাসিত করতে হবে। আর নতুনভাবে যাতে কোনো মাদকসেবী তৈরি হতে না পারে, এই জায়গাটুকুতে সমাজের অন্য যাঁরা আছেন তাঁদের কাজ করতে হবে। উদ্বুব্ধ করতে হবে। সবাই উদ্যোগী হলে মাদক সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান করা সম্ভব।

প্রতিবেদক : মাদক গডফাদাররা আইনের আওতায় আসবে কবে?

জাবেদ পাটোয়ারী : ধরুন, যারা এই কারবারের সঙ্গে সম্পর্কিত তারা শুধু পুলিশের শত্রু নয়, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। তারা পুরো যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা পুরো ভবিষ্যেক ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। আমরাও বলতে চাই, তাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে। মাদক নির্মূল করার জন্য একটি বিশেষায়িত সংস্থা আছে, তা আপনি জানেন। সেটি হলো মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর; যাদের একমাত্র কাজ হলো মাদক নিয়ে কাজ করা। আমরা মনে করি, তাদেরও জনবল দিয়ে হোক বা ইকুইপমেন্ট দিয়ে হোক, আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। তা ছাড়া মাদকসেবীদের নিরাময় করা, পুনর্বাসিত করার বিষয়গুলোও কিন্তু তারা দেখে থাকে। তারা যদি সঠিকভাবে সমৃদ্ধ হয়, তাহলে তারা বিশেষ একটা অবদান রাখতে পারবে। আমাদের এখানে মাদক উৎপাদিত হয় না। আপনি ইয়াবার কথা বলেন, ফেনসিডিলের কথা বলেন, কোনোটিই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না। হেরোইনও অন্য দেশ থেকে আসে। মাদকগুলো আসার সময় নিশ্চয় সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়। সীমান্তে যারা দায়িত্ব পালন করে তারা যদি আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে কিন্তু চালান আসাটা বন্ধ হয়ে যাবে। জোগান দেওয়াটা কমে আসবে। সুতরাং সবাই মিলে যদি সঠিকভাবে কাজ করি, গডফাদারসহ অন্যদের ধরা যাবে এবং মাদকের অপব্যবহার কমে আসবে। আর এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

প্রতিবেদক : মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না?

জাবেদ পাটোয়ারী : আপনারা জানেন, মিয়ানমার সীমান্তে মূলত বিজিবি ও কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করে। সীমান্ত গলিয়ে যাতে ইয়াবা প্রবেশ না করতে পারে সে জন্য তারা কাজ করছে। মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কয়েক দিন আগে আমাদের দেশ ঘুরে গেছে। ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, পুলিশের বেশ কিছু সদস্য ও নারকোটিকসের প্রধান ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে প্রথম যে মিটিংটি হয় সেখানেও মাদক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে দুই দেশের আইজিপির মিটিং হয়। সেখানেও আমরা মিয়ানমার পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছি। ওই দেশের মাদক কারখানা বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়েছে। ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার তালিকা তাদের দেওয়া হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে, তারা এ বিষয়ে কাজ করবে। আর আমাদের সঙ্গে তারা একযোগে কাজ করতে আগ্রহী। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই, তারা যদি সঠিকভাবে এগিয়ে আসে, সীমান্তের এপার-ওপারের দুই দেশের পুলিশ কাজ করতে পারে, তাহলে মাদক নির্মূল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবেই।

প্রতিবেদক: অভিযোগ আছে, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা মাদক কারবারিদের সহায়তা করেন—বিষয়টি কিভাবে দেখেন?

জাবেদ পাটোয়ারী : মাদক কারবারিরা যখন কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সেটা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ আছে কি না, তা জানি না। তবে শুধু এ ক্ষেত্রে আপনাকে বলতে চাই, যদি মাদক কারবারিদের সঙ্গে কোনো পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য যোগাযোগ রাখে অথবা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার প্রমাণ পাই, তাহলে তার অপরাধ ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য করব। আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই কিন্তু কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছি, কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী গ্রহণ করবে না। তাকে আমরা ব্যক্তির অপরাধ হিসেবেই গ্রহণ করব। একজন সাধারণ নাগরিক যদি এ ধরনের অপরাধ করত, সেই ব্যক্তি আইনের আওতায় আসত। তাহলে পুলিশের কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে আইনের আওতায় আসবে না কেন? অবশ্যই তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা হবে। বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

সম্পাদনা / সৈয়দ মনির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *