বঙ্গবন্ধু যেভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর পরিকল্পনা করেছিলেন

 

ডেস্ক রিপোর্ট :

দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় তিনি সর্বস্তরে বাংলা চালুর এই পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন।

১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমিতে শহীদ দিবস (ভাষা শহীদ দিবস) উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার বাংলা একাডেমি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি কোনো ছুটির দিন ছিল না। তবুও সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে প্রখ্যাত লেখক, কবি, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ।

বঙ্গবন্ধু এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। বাংলা একাডেমির সে সময়কার চেয়ারম্যান প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুরতজা আলীর সভাপতিত্বে সেদিন স্বাগত বক্তব্য দেন বিশিষ্ট লেখক ও বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক কবির চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য অনেক বক্তৃতার মতোই সেদিনের বক্তৃতাও দেশের প্রধান প্রধান বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের দেয়া এসব বক্তৃতা থেকে নির্বাচিত বক্তৃতা নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। মুক্তধারা প্রকাশন ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ নামে এই সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করে।

ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, তার দল ক্ষমতায় আসলে শুরুতেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা হবে। তিনি সেদিন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য কীভাবে বাংলা পরিভাষা তৈরি করা হবে সে ব্যাপারেও পরামর্শ দেন।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সরকারি অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।’

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া দেশের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তা সত্ত্বেও এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা খুব কম ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় বই ও পরিভাষার অভাবের অজুহাতে এখন উচ্চ আদালতে দাফতরিক কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা তখনই শুরু করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষার অপেক্ষা করব না। তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না।

তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি বলেন, ভাষার গতি নদীর স্রোতের ধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতিরোধ করতে পারে না।

তিনি লেখক, কবি এবং নাট্যকারদের মুক্তমনে লেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যই সাহিত্য। এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন। দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন।

তিনি বলেন, আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *