চিররঞ্জন সরকার :
৩০ অক্টোবর ২০১৭।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। এতে সে সময়ের মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং অপর প্রায় ৫০০ জন আহত হয়েছে। শেখ হাসিনা ওই হামলায় ‘দৈবক্রমে’ প্রাণে রক্ষা পান। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
হামলা-আক্রমণের ঘটনা কিন্তু এখনও ঘটছে। কিন্তু তা তেমনভাবে ‘দাগ’ কাটতে পারছে। ঘাতকরা কেমন যেন হিংস্র ‘বাঘ’ থেকে নখদন্তহীন ‘ছুঁচো’য় পরিণত হয়ে গেছে! খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটির কথাই ধরা যাক। গত শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফেনীর ফতেপুর রেলক্রসিং অতিক্রম করার পরপরই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করা হয়েছে। হামলাকারীরা ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এর মধ্যে সাংবাদিকদের গাড়িও ছিল। এই হামলায় কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাকে গণতন্ত্রের জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতারা। এটা আসলেই ‘অশনি সঙ্কেত’! হামলা হচ্ছে, অথচ কেউ তেমন প্রবলভাবে হতাহত হচ্ছে না! কারও যদি মাথাই না ফাটলো, প্রাণটাই কেড়ে নেয়া না গেল, তাহলে মিছেমিছি হামলা চালিয়ে লাভ কী? ভয় দেখানো? খালেদা কিংবা বিএনপি কী আর ‘শিশু’ যে, তাদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে? বিষয়টি লজ্জারও বটে।
ওদিকে নওশাদ আহমেদ নামে ৫২ বছর বয়সী এক রোগী হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) মারা যান। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে আটজন চিকিৎসক, নার্স, স্টাফ ও আনসার সদস্য আহত হন।
দেখা যাচ্ছে তুচ্ছ কারণে, অনেক ক্ষেত্রে অকারণে হামলা, হাতাহাতি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। না প্রতিপক্ষকে উচিত শিক্ষা দেয়া যাচ্ছে, না কাউকে ‘ভবতরি’ পার হতে সহায়তা করা যাচ্ছে!
এসব ঘটনা আমাদের যার পর নাই হতাশ করছে। হাতাহাতি-মারামারি, ভাঙচুর এগুলো খুবই ‘সেকেলে’ ব্যাপার। এখন হলো খুনোখুনি রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানোর যুগ। লাশ ফেলে দেয়ার যুগ! এ যুগে এসে সামান্য হাতাহাতি, ভাঙচুরের মধ্যেই ক্ষোভকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলে? খবর হিসেবেও এসবের তেমন কোনো মূল্য বা মর্যাদা নেই। এগুলো আমাদের কাপুরুষতা কিংবা ছ্যাঁচরামিকেই প্রকাশ করে মাত্র। ‘বীরেরা’ হামলা করে মারার জন্য! প্রয়োজনে তারা মরেও! কিন্তু ছ্যাঁচড়ারা হামলা, ভাঙচুর, হাতহাতি-এসব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে! এগুলো আমাদের বীরত্বকে ম্লান করে দেয়!
যারা এসব করছে, তারা আসলেই জাতির কলঙ্ক! উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের দিক তাকান। তিনি আমেরিকাকে শাঁসাতে পারমানবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা মারার হুমকি দিচ্ছেন। আমেরিকার দিকে তাকান। সেখানে তুচ্ছ কারণে, অনেক সময় বিনা কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ঠা-ঠা গুলি করে ডজন ডজন লোক মারছে। আর আপনারা কেউ কারো মাথাটাও ফাটাতে পারছেন না! তাহলে হামলা আর ভাঙচুর করে কী লাভ? সত্যি, হামলাকারীদের ব্যর্থতা ও কাপুরুষতায় ‘বীর’ মাত্রই লজ্জা পাবেন!
একটা সময় ছিল যখন কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে, কেউ ঘোরতর স্বার্থ-পরিপন্থী কাজ করলে তাহলেই কেবল দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হত। এই ঝগড়া-বিবাদের সূত্র ধরে মাঝে-মধ্যে মারামারি-হাতাহাতি হত। খুনোখুনি হত কদাচিত্। তবে এখন আর সেই ‘সেকেলে’ সংস্কৃতি নেই। এখন ঝগড়া-বিবাদের চেয়ে খুনোখুনি হয় বেশি। তুচ্ছ কারণে লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে আত্মীয়, স্বজাতি, সহকর্মী, প্রতিদ্বন্দ্বী—কোনো বাছবিচার করা হচ্ছে না। পছন্দ না হলেই ঠুস। হিসাবে না মিললেই জবাই। মাথা তুললেই খুন। তা সে যেই হোক। আমরা কি তবে এই ‘নতুন ধারা’য় আস্থাহীন হয়ে পড়ছি?
এসব খুচরা হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা দেখে বাল্যকালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমরা শৈশবে দেখেছি পারিবারিক পরিমণ্ডলে ‘মাইর’ মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছে। পান থেকে চুন খসলেই আমাদের বাবা-মা এমন ছ্যাঁচা দিতেন যে আমরা তাদের নাম পর্যন্ত ভুলে যেতাম। আমরাও ছোটকালে একেকজন ছিলাম বেসম্ভব বদের হাড্ডি। জ্বালাতন করার জন্যে ছেলে হোক, মেয়ে হোক একটা বদের হাড্ডিই যথেষ্ট। আর আমরা তো ছিলামও রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর মতো হালি হালি। আর আমাদের অভিভাবকরাও ছিলেন সেই মাপের সিরিয়াস। এমন কোনো প্রচলিত পারিবারিক ‘ডাণ্ডা’ নেই যা প্রয়োগ করা হতো না। কিল-চড়-লাথি জুতার বাড়ি, ঝাড়ুর বাড়ি, হ্যাংগার, চামচ, খোন্তা, ডাল-ঘুটূনি কোনটাই বাদ যায়নি। মাইরের ফলশ্রুতিতেই কিনা কে জানে, আমরা এখনও ‘ভদ্রলোক’ রয়ে গেছি। মা-বউ-বোন-বাপ এবং বাকি সমাজের কাছে ‘অকর্মার ঢেঁকি’ বা ‘সুশীল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আমাদের অভিভাবকদের ধারণা, আমরা যে এতটা ‘সুশীল’ হয়েছি এটা ছোটকালের সেই ‘ছ্যাঁচা’ বা মাইরেরই ফল!
তবে এখন আর সেই যুগ নেই। এখন মা-বাবারা অনেক ‘ভালো’ হয়ে গেছেন। নিজের পরিবারেই দেখি, আমার ভাইপো-ভাইঝি কিংবা ভাগ্নে-ভাগ্নিরা রীতিমতো অসুরের ভূমিকায় লিপ্ত। যেন ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলের ক্যাডার। কেউ কাউকে মানে না। কোনো কথা শোনে না। যেখানে যায় মোটামুটি পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব কিছু লন্ডভন্ড করে ফেলে। ভাঙচুরেও তাদের কোনো জুড়ি নাই। তারপরও আমি অবাক হয়ে দেখি ওদের বাবা-মা কেউ কিছু বলে না। বেশ একটা গর্ব গর্ব ভাব নিয়ে তাকিয়ে দেখে। যেন তার সন্তান এক বিরাট কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করছে!
তবে যে যতো কথাই বলুক, মাইরের দরকার আছে (মামুলি হাতাহাতি, অতর্কিতে আক্রমণ, ভাঙচুর নয়), আরও ব্যাপক বিশাল আক্রমণ, মারামারি-রক্তারক্তি। প্রয়োজনে হত্যা-গণহত্যা করতে হবে। তবেই সাফল্য এসে ধরা দেবে। বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস-একথা বলে মাও সে তুঙ বিখ্যাত হয়ে আছেন। মাও সাহেব আসলে ‘বন্দুকের নল’ বলতে শক্তি বা ডাণ্ডাকে বুঝিয়েছেন। আমাদের পরিবারগুলো একসময় টিকে ছিল এই শক্তি বা ডাণ্ডা ব্যবহারের উপর। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমন করা অত্যন্ত প্রাচীন এবং কার্যকর একটি নীতি। ‘মাইরের ওপর কোন ওষুধ নাই’-এটা আমাদের সমাজে একটি সর্বজনস্বীকৃত উক্তি। ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার এ দাওয়াই যুগে যুগে অনেকেই প্রয়োগ করেছে। ক্ষমতার মোহে উন্মত্ত স্বৈরশাসকরা অশিষ্ট-অবাধ্যদের শায়েস্তা করতে, নিরীহদের বশে রাখতে যুগ যুগ ধরে ডাণ্ডার ওপরই ভরসা করেছে। সমালোচনা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, যে কোনো ধরনের বিরোধিতা দমন ও প্রতিপক্ষকে ঠাণ্ডা করতে ডাণ্ডার কোনো জুড়ি নেই। আইয়ুব, ইয়াহিয়া থেকে শুরু করে জিয়া-এরশাদ পর্যন্ত সবাই ডাণ্ডার ওপর নির্ভরশীল হয়েই ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করেছেন। ডাণ্ডা যে কোনো ‘শক্তিমান’ শাসকের জন্যই প্রধানতম অবলম্বন। একমাত্র ভরসা।
আমাদের দেশে ডাণ্ডাবাজদেরই জনগণ সমীহ এবং সম্মান করে। ডাণ্ডার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারলে উদাসীনও কর্তব্যনিষ্ঠ হয়। অলসও চটপটে হয়। ঘাড়ত্যাড়াও সোজা হয়ে যায়। ডাণ্ডা, লাঠি, লাঠিপেটা, মাইর মোটের ওপর শক্তি প্রয়োগের নীতি অনেক অসাধ্যকে সাধন করে। মাইরের ওপরে সত্যিই কোনো ওষুধ নেই। মাইরের চোটে ঠাণ্ডা বা সোজা হয়নি, এমন উদাহরণ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাইর একাধারে অপরাধী, অশিষ্ট, পাগল, ভূত-সবাইকেই শান্ত বানিয়ে ফেলে। প্রাজীনপন্থিরা তো এখনও বলেন: আমাদের সমাজে যতটুকু যা শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা তা সম্ভবত ওই লাঠি, ডাণ্ডা বা মাইরেরই অবদান! অপরাধীদের কথাই ধরা যাক। রিমান্ডে না নিলে অর্থাৎ না প্যাঁদালে কারও পেট থেকে কোন তথ্য বের হয় না।
কোনো গুরুতর অভিযোগে কাউকে আটক করুন, এরপর বাবা-সোনা বলে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করুন, সেই ওই কর্মটি করেছে কি না, নিশ্চিতভাবেই সে তা অস্বীকার করবে। অথচ তাকে আচ্ছা মতো পেঁদিয়ে তারপর জেরা করুন, সে যা করেছে তা তো স্বীকার করবেই; এমনকি যা করেনি, তাও সুবোধ বালকের মতো কবুল করবে। এই ডাণ্ডা অস্ত্র প্রয়োগ করে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কত না অসাধ্য সাধন করছে।
আসলে মাইরের একটি আলাদা শক্তি আছে। এর মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে যেমন ভেস্তে দেয়া যায়, ঠিক তেমনি অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। তবে মামুলি হাতাহাতি, আক্রমণ, ভাঙচুর দিয়ে কোনো স্বার্থই হাসিল হবে বলে মনে হয় না। বিএনপির সমাবেশে যারা হামলা-ভাঙচুর করছে, ডাক্তারদের উপর যারা চড়াও হচ্ছে, কিংবা আরও যারা নানা কারণে বা অকারণে মারামারি, হাতাহাতি করছে, তাদের উচিত খুনোখুনির বিদ্যায় আরও পারদর্শী হওয়া! তা না হলে আমরা এগোতে পারব না। অপরের সমীহও আদায় করতে পারব না। শুধু শুধু কয়েকটা গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে, কয়েকজন চিকিৎসককে ভয় দেখিয়ে, নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি করে আমরা কে, কাকে. কী শিক্ষা দেব?
শিক্ষা যদি দিতেই হয়, একেবারে ‘পরপারে’ পাঠিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে হবে! শুধু শুধু ‘মশা’ মেরে হাত নষ্ট করার মানে কী?
সুত্র- চ্যানলঅাই।