মুক্তিযোদ্ধা আফছারের স্মৃতি শুধুই যাতনার- নুর আয়েশা সিদ্দিকা

মুক্তিযোদ্ধা আফছারের স্মৃতি শুধুই যাতনার- নুর আয়েশা সিদ্দিকা/

আবছার যখন বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করে তখন রাত প্রায় বারোটা। কিন্তু ঝি ঝি পোকার ঘুম পাড়ানি গান আর নিকষ রাতের নিস্তব্দ পরিবেশ রাত্রির বয়সকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। ও বেড়ালের মত নিঃশব্দে পা টিপে টিপে দরজার কাছে যেতেই সর্ন্তপনে দরজাটা খুলে যায় আবছার চমকে ওঠে প্রশ্ন করে -বুবু তুমি এখনও ঘুমাওনি? বুুবু চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলেন – এত রাত পয্র্ন্ত তুই কোথায় ছিলি খোকা ভাই? জানিস আব্বা মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরার পথে দেখেন তোর পড়ার ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে, এশার নামাজ পড়ে ফেরার পথেও দেখেন একই অবস্থা। রাগে আব্বা সারা বাড়ি মাথায় তুলেছেন, বলেছেন তোর বই খাতা সব আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবেন। তোকে দিয়ে পড়া লিখা হবেনা। আবছার বিষন্ন গলায় বলে -কি করব বুবু? দেশের এমন এক পরি¯িহতি। এসময় কি শান্ত সুবোধ ছেলে হয়ে ঘরে বসে থাকা যায় ?দেশের প্রতিতো কর্তব্য ও রয়েছে। ও বলে জানো-বুবু আজ কি হয়েছে ছাত্রদের সমাবেশে পুলিশ গুলি ছুড়ে সেন্ট্রাল ল কলেজের ছাত্র আসাদকে হত্যা করে। আসাদের বুকের রক্তে পিচ ঢালা কালো পথ লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে ওর গলা উওেজনায় বুজে আসে। বুবু তন্ময় হয়ে শুনেন ভাইয়ের কথা। এক সময় হাত ধরে খাবার ঘরে নিয়ে যান। কুপির আলোটাকে আর একটু উস্কে দিয়ে ভাত বাড়েন থালায়। প্রাণ উচছল ছোট ভাইটির কাছ থেকে শোনেন আরও না জানা অনেক কথা। খাওয়া শেষ হলে আবার সাবধান করেন ভাইকে -খোকাভাই যাই করিস রয়ে সয়ে করবি ।আব্বা রেগে গেলে কিন্তু বিপদ হবে। আবছার মৃদু হেসে আশস্ত করে বুবুকে।

এভাবেই সময়েরা পথ চলে প্রতিদিন প্রতিক্ষন শাসকের বিমাতা সুলভ আচরণ, তৃতীয় কোন শক্তির গোপন ষড়যন্ত্র,আর জনতার প্রকাশ্য দাবী আদায়ের প্রতিবাদ মুখর পদচারণায় মুখরিত হয়ে এক রক্তরাঙা ইতিহাসের বীজ বপনে সবুজ বাংলার বুকে রক্ত লাল পেইনটিং ব্রাশ নিয়ে । জীবন ছুটে চলে স্রোতের টানে ব্যতিক্্র্্রম হয়না সুজাপুর গ্রামের অব¯হাপন্ন পরিবার মৌলভী আহমদ করিমের পরিবারেও। সাত ছেলেও এক মেয়ের মাঝে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন বছর পাঁচ আগে। ছোট্র দুটি নাতি নাতনী , জামাই শহরে চাকরী করেন। বাকী সাত সন্তানের মাঝে আবছার ছাড়া সবাই ছোট এবং কাছাকাছি বয়সের। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবছার কলেজে ছাত্র আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা। আর তাকে নিয়েই আহমদ করিমের যত পেরেশানি। দিনকাল ভাল নয়। কখন কি হয় বলা যায় না। এরই মাঝে ছেলেটা রাত বিরাতে ও মিটিং মিছিলে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে কেবল ওর চেয়ে বছর পাঁচেক বড় বুবুর কথাই খানিকটা শুনে। আর না হয় পারত পক্ষে কারো ছায়া ও মাড়ায় না। ভাইয়ের প্রতি মুহুর্তের সংগ্রামী কাজের নিরব সমর্থক বুবুর কাছে সারাদিনের সংসারের কাজের পর রাত জেগে খাবার বেড়ে প্রতিক্ষার প্রহর গোনা ও কষ্টকর মনে হয়না। কেননা এ সময়ই কেবল দুভাই বোন নিরিবিলিতে অভাগা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ পায়।

পঁচিশে মার্চের কালো রাতের শোক ছাপিয়ে একদিন আবছার বুবুর মুখোমুখি হয়। -বুবু আমার জন্র্য আর কষ্ট করে তোমায় রাত জাগতে হবেনা, আব্বার বুকুনি খেতে হবেনা । বুবু ওর আতœপ্রত্যয়ী কন্ঠে চমকে ওঠে বলেন -কেন কি হয়েছে ও কথা বলছিস কেন ?আবছার চোখের তারায় আলোর ঝিলিক ফুটিয়ে বলে – আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি যুদ্বের ট্রেনিং নিতে। দেশ এখন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন সামনে আরো কঠিন অবস্থা তৈরী হবে। তাই আমি নিজকে আগামী দিনের দেশ রক্ষার প্রয়োজনে তৈরী করতে চাই। বুবু আপত্তি তুলেন – কিন্তু তোর পড়ালিখা? আবছার কন্ঠের প্রত্যয় ধরে রেখে বলে -একটি বৃহত্তর প্রাপ্তির জন্য আমি যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি, প্রয়োজনে আমার জীবন ও। আমি যাবার জন্য তৈরী হয়েই এসেছি। বুবু ওর হাত ব্যাগটির দিকে তাকিয়ে ঊদ্বিগ্ন গলায় বললেন – কিন্তু তাই বলে কোন টাকা পয়সা ছাড়া এভাবে খালি হাতে ::::;আবছার দৃঢ় কন্ঠে বলে – বুবু মসজিদের ইমাম সাহেব জুমার খোতবায় বলেছেন -দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। তাই আমি মনে করি আল্লাহই আমার এই একাকী পথ চলার সহায় হবেন। বুবু ওর হাতটা চেপে ধরেন -খোকা ভাই একটু দাড়া। তারপর দৌড়ে ঘরে যেয়ে আবার দ্রুত ফিরে আসেন। -এই নে আমার জমির ধান বিক্্ির করা টাকা। পথে তোর দরকার হতে পারে। আবছার তীব্র ভাবে প্রতিবাদ করে -না বুবু এ হয়না ।তুমি দুলাভাই কে না জানিয়ে এতগুলো টাকা আমাকে দিওনা ।উনি জানলে রাগ হতে পারেন। বুবু স্বস্নেহে হেসে বলেন-দুর পাগল আমি তোর প্রতিটি কাজ কর্মই তোর দুলাভাই কে লিখে জানাই। তোর প্রতিটি কাজের ব্যাপারেই ওর সমর্থন রয়েছে। তুই এ নিয়ে ভাবিস না। তখন আবছার ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে- বুবু তুমি বাবা মাকে আমার সালাম জানিয়ে আমার হয়ে মাফ চেয়ে নিও। আর বিশেষ করে বাবাকে বলবে – সাত ভাইয়ের মধ্য হতে আমি একজন না হয় দেশের জন্য নিজকে বিলিয়ে দিলাম। আব্বা যেন আমার উপর কোন দাবী না রাখেন ,আর বাকীদের দিয়ে যেন আমার শূন্যতা পূরণ করে নেন ।এটুকু বলে ও হনহন করে হ্েেট উঠোন পার হয়ে যায়। বুবু করুণ গলায় বলেন -হায়রে বোকা তুই কি করে বুঝবি বাবা মায়ের কাছে সন্তানের শূন্যস্থান যে কিছুতেই পূর্ণহবার নয়।

ধীরে ধীরে দেশ একটি অবশ্যম্ভাবী মুক্তিসংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে ।্আবছার ও একদিন ফিরে আসে একজন প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্বা হিসেবে। বুবু তো দেখে বিস্ময়ে হতবাক। ওর তারুন্যের সেই ্উছ্ছলতা যেন দেশ রক্ষার বিশাল দায়িত্ব অনুভুতির কাছে লীন হয়ে গেছ্।েওর আচরণে বেশ দায়িত্বশীল একটা ভাবপ্রকাশ পাছ্ছে । ও বুবু কে বলে -এখন থেকে আমি বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনে ব্যাস্ত থাকবো তো তাই আমার পক্ষে রেগুলার বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। তবে মাঝে মাঝে তোমাদের সাথে এসে দেখা করে যাবো। ছেলের পড়া লিখা বাদ দিয়ে এই ধরনের উড়নচন্ডী কর্মকান্ডে বাবা আহমদ করিম প্রথম প্রথম বিক্ষুদ্ব হলেও শেষ পর্যন্ত পিতৃস্নেহের উষ্ণতার কাছে পরাজিত হয়ে অভিমানের বরফ গলতে শুরু করে। একদিন তিনি বড় মেয়েকে ডেকে নরম গলায় বললেন – মাগো আমার তো বয়স হয়েছে। কখন রাগ করে কি বলেছি তাকে ধরে রেখে পাগল ছেলেটা যে আমার মুখ দেখাও বন্ধ করে দিয়েছে । ওকে বলিস শত হলেওতো আমি ওর জন্মদাতা বাবা । আমার বুকটা ওতো কাঁদে ওকে এক নজর দেখার জন্য। বুবু বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে প্রবোধ দেয়-আব্বা আপনি চিন্তা করবেন না। চারদিকে শত্র“ মিত্র নানা রকম মানুষ তো। তাই ও দিনের বেলা বাড়ি আসেনা। এবার রাতে এলে আপনাদের অবশ্যই ডেকে দেব।

কখনও বেশী কখনও কম এখানে ওখানে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর ছোট বড় সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। এর মধ্যে পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কেউ কৌতুহলী গলায় অনুসন্ধানের সার্চ লাইট জ্বালায়- মৌলভী সাহেব শুনলাম আপনার বড় ছেলে আফছার নাকি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে? এই সংকট ময় মুহুর্তে মানুষ নিজের ছায়া দেখেও আতংকে চমকে উঠে। আর শত্র“ মিত্রের পার্থক্য করা তো রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই মৌলভী সাহেব ছেলের প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ এটে থাকেন। তারপর ও শেষ রক্ষা হয়না। এ ঘটনা দেশীয় চরদের মাধ্যমে পাকসেনাদের ক্যাম্পেও গিয়ে পৌছে। সঙ্গে সঙ্গে পাক সেনারা তাদের কর্তব্য কর্মে তৎপর হয়ে উঠে। দলবল নিয়ে আগমন করে মৌলভী সাহেবের বাড়ি -তুম মুক্তিকা বাপ হ্যায়? মৌলভী সাহেব দিগন্তে বিপদের কালো মেঘ দেখে শিউরে উঠেন -না না হামারা লেড়কা মুক্তি নেহি হ্যায়। বহুত সাচ্চা মুসলিম হ্যায়। তখন পাকিস্হানী সেনা অফিসার রাগত স্বরে বলে -বোলাও তোমারা লেড়কাছে। মৌলভী সাহেব এবার জান বাঁচাতে বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেন। -ও ভি খালাকো ঘরমে গিয়াথা। তখন পাশ হতে হানাদারদের এ দেশীয় চর ফিসফিসিয়ে বলে – –ও ভি ঝুট বলতা হ্যায়। ও লেড়কা কো খালা ভি নেহি হ্যায় । ওহি মুক্তিফৌজ মে গিয়া থা। সঙ্গে সঙ্গে পাক কমান্ডার গর্জে উঠে -ইয়ে মুক্তি কা ঘরমে আগুন লাগায়ে দাও। শত অনুনয় বিনয় করে ও থামানো গেলনা। কোন মতে বাড়ির চাকরদের সহযোগিতায় নারী ও শিশুদের বের করা গেল। মুহুর্তেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল মৌলভী সাহেবের কাচারী ঘর, থাকার ঘর সহ সমস্থ বাড়ি ঘর, গরুসহ গোয়াল ঘর ও বাদ গেল না। বাড়ির নারী, শিশুরা আতঙ্কে আশেপাশের বাড়িঘরে আশ্রয় নিল। মৌলভী সাহেবের মনে হল কোরআনের নির্দেশ।

ধর্মের দোহাই দিয়ে যুদ্বে লিপ্ত এই কমান্ডারকে এই অধর্মের কাজে বাধা দেয়ার শক্তিটুকুও যে মৌলভী সাহেবের নেই। বাড়ির শেষ বস্তুটিও পুড়ে ছাই হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে কমান্ডার পাহারায় থাকলেন। তাই বাড়ির কাজের লোকদের প্রচন্ড চেষ্টা থাকা সত্বেও কোন কিছুই রক্ষা করা গেলনা। সন্ধ্যে বেলা পুরো বাড়িটি একটি পোড়া ছাইয়ের গাদায় পরিণত হল। প্রতিবেশীর বাড়িতে শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে এসে বুবু ছাইয়ের গাদায় কাজের লোকদের সাহায্য নিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেও ঠিক মাটির নিচে কোথায় গহনার বাক্সটি পুঁতে রেখেছিলেন তার হদিশ করতে পারলেন না। অনেক কষ্টে বহু যতেœ রাখা বিয়ের শাড়ির ট্রাংকটি খুঁজে পেলেন। কিন্তু তা তীব্র আঘাতে কালচে হয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্নের মতই কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। বেদনায় মুক হয়ে যাওয়া বুবুর চোখ হতে অশ্র“রা গড়িয়ে পড়ে সেই বিবর্ণ শাড়ির উপর। এমন সময় মৌলভী সাহেব ছুটে আসেন, তীব্র আক্ষেপের সাথে বলেন -জানিস মা পাকহানাদাররা যখন বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল তখন বাছুর সহ লাল গাভীটাকে গফুর গোমস্তা ওদের বাড়ি নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল ।কিন্তু হানাদাররা যাওয়ার সময় ওই বাড়ি গিয়ে গরু দুটোকেও শেষ করে দিয়েছে। কষ্টে মৌলভী সাহেবের গলা ধরে আসে। বুবু জানেন এই লাল গরুটি বাবার কত প্রিয় ছিল। তাই তিনি এসে সমবেদনার ভঙ্গিতে বাবার হাত ধরেন। তখন মৌলভী সাহেব ক্ষোভের সাথে বলেন-মা হানাদারদের দোষ দেইনা। ওরা তো এদেশে এসেছে আমাদের কষ্টই দিতে। ওদের কাজই তো আমাদের জানমালের ক্ষতি করা। কিন্তু কষ্ট হয় নিজের ঘরের মানুষ গুলোর উপর। আজ যদি ওরা চিনিয়ে না দিত তবে হানাদারদের তো জানার কথা নয় কার ঘরে গরু গুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছে। রাত আর একটু গভীর হলে আবছার চুপিসারে বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। পোড়া ছাইয়ের স্তুপের সামনেই ও মৌলভী সাহেবের মুখোমুখি হয়। অপরাধীর মত বাবার দিকে এগিয়ে যায়। নত মুখে বলে Ñআব্বা আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমার জন্যই আজ আপনাদের এত… তার কথা শেষ হবার আগেই মৌলভী সাহেব তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠেন -আয় বাবা কতদিন ধরে তোকে আমি দেখিনা। আয় আমার বুকে আয়। আজ আমার বুকের মাঝে যে কষ্টের আগুন জ্বলছে তা তোকে জড়িয়ে ধরে ঠান্ডা করি। অনেক কষ্ট আর খোয়ানোর ব্যাথ্যা নিয়ে আজ পিতা পুত্রের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয় ।যে অবশ্য করনীয় কর্তব্যের ডাক হতে পিতা মৌলভী আহমদ করিম ছেলেকে দুরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন আজ এক নির্মম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তা নিজে নিজেরই স্বীকৃতি আদায় করে নিল। বাবা ছেলের এই মিলনে বুবুর কান্না ধোয়া মুখটা ও হাসিতে উজ্জল হয়ে উঠল। তিনি বলে উঠেন -জানিস আবছার তোর ছোট ভাগনীনিটিও যে তার মামার মতই সাহসী হয়ে উঠেছে। আজ যখন পাক হানাদাররা উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা তোর সাইকেলটি নিয়ে যেতে চাচ্ছিল তখন ও ওর ছোট দুটি হাত দিয়ে সাইকেলটি চেপে ধরে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল – মামাল সাইকেল নিয়ে যেতে দেবনা। আবছার তখন বলে -বুবু আমি আজ ওদের সমস্ত জুলুমের কথাই শুনেছি। আমার গ্র“পের ছেলেরাও চাচ্ছিল আজ রাতেই ওদের ক্যাম্প আক্্রমণ করতে। কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম আজ ওদের অতর্কিতে আক্্রমণ করে পরাজিত করলেও দুদিন পর ওরা দ্বিগুন শক্তি নিয়ে এর জের ধরে নিরীহ গ্রামবাসীকে অত্যাচার করবে ।তাই অনেক কষ্টে ওদের দমন করেছি। মৌলভী সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন -আলহামদুলিল্লাহ তোমার এই সিদ্বান্তে আমি খুশী হয়েছি।তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করোনা। দেশের কল্যানের জন্য আমরা যে কোন ধরনের কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি । আবছার বুবুর দিকে তাকিয়ে বলে -–বুবু আমি জানি তোমার বিয়ের শাড়িটি তোমার কত প্রিয় ছিল । আমার জন্য… বুবু ওকে বাঁধা দিয়ে বলেন -থাকনা ওসব কথা ।আমার শাড়ির রঙের রক্ত লাল স্বাধীনতার সূর্য নিয়ে তুই যেদিন ঘরে ফিরবি সেদিন তার দিকে তাকিয়ে আমি না হয় আমার শাড়ির শোক ভুলে যাবো। আজই প্রথম বারের মত কষ্টের ধ্বংস স্তুপের সামনে দাড়িয়েও বাবা ও মেয়ে হাসি মুখে বিদায় জানায় আবছার কে।

ঘর পোড়ার দুর্ঘটনার খবর শহরে বুবুর স্বামী রহমান সাহেবের কানে ও গিয়ে পৌঁছে ।তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন পরিবার পরিজনের খবর নিতে। অবশেষে কখন ওপায়ে হেঁটে কখন ও লুকিয়ে তিনি শহর থেকে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথে পথে পোড়া ঘর বাড়ি আর লাশের ধ্বংস স্তুপ দেখে তিনি ঘটনার বিভৎসতায় শিউরে উঠেন। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর ও ঘন্টা খানেক বাকি এমন সময় গামছা গায়ে দেয়া দুটি ছেলে তাকে রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। দেখেন বাড়ির উঠোনে হাত পা বেঁধে কিছু লোককে বসিয়ে রাখা হয়েছে। রহমান সাহেব কে দেখিয়ে গামছা পরা ছেলে গুলোর একটি বলে উঠলো -শরীফ ভাই দেখেন। আর একটা রাজাকার কে ধরে এনেছি। তখন শরীফ ছেলেটি নির্দেশ দিল -একেও হাত পা বেঁধে ফেল। মুক্তিযোদ্বাদের যখন পাকহানাদারদের ধরিয়ে দেয় তখন খেয়াল থাকেনা। এখন মজা টের পাবে ।রহমান সাহেব ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিয়ে যান প্রথমটায়। পরে সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করেন -ভাই আপনারা ভুল করছেন, আমি রাজাকার নই। আমি শহরে চাকরি করি। আজ গ্রামে ফিরছি আমার পরিবার পরিজনের সাথে দেখা করার জন্য। তখন শরীফ ছেলেটি গর্জে উঠে – তাহলে তো আপনি আরো খারাপ। পাকিস্থানের সাথে আমাদের যুদ্ব চলছে। আর আপনি এখনও ওদের চাকরী করেন। এই বাঁধ ওনাকে। সব কটাকে মাঠে দাঁড় করানো হয়। একে একে গুলি করে সব কজন কে হত্যা করা হয়। নিরীহ প্রকুতির রহমান সাহেব অবাক চোখে দেখেন পাকসেনাদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত যে লাশ গুলো তিনি পথে পথে দেখে এসেছেন তাদের রক্তের রঙ আর মুক্তিযোদ্বাদের হাতে নিহত লাশ গুলোর রক্তের রং যে একই ।পথে পথে দেখা বোমার শব্দ, বারুদের গন্ধ, মূত্যু যন্তনা কাতর মানুষের কাতর ধ্বনি,সন্ত্রম হারা গূহ বধুদের আর্তনাদ, ভয়ার্ত শিশুর কান্না সব মিলিয়ে মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগল। কবে শেষ হবে এই ভ্রাত’ঘাতী সংঘাতের। এই দেশের বাতাসে মিশে যাওয়া বারুদের গন্ধ একদিন শেষ হলেও স্বজনদের মনের আকাশ হতে নিশেঃষ হবে কি প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা। রহমান সাহেবের মাথার ভেতরটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তিনি টলে মাটিতে পড়ে যান। পড়ার সময় মনে হয় যেন একটি গুলির শব্দ তার কানের পাশ দিয়ে শিষ কেটে ছুটে গেল। যখন তার হুশফিরে তখন তিনি দেখেন তার মুখের উপর উৎসুক একটি মুখ ঝুঁকে আছে। তিনি উঠে বসেন। আবছার -দুলাভাই বলে জড়িয়ে ধরে। চারপাশে অপরাধীর মত মুখ করে বাকি মুক্তিযোদ্বারা দাঁড়িয়ে। আবছার ক্ষমা চায়-দুলাভাই আমার সাথীদের আপনি মাফ করে দিন। ওরাও লজ্জিত মুখে একে একে উনাকে জড়িয়ে ধরে -সত্যিই দুলাভাই আমরা সবাই ক্ষমাপ্রার্থী। আবছারের কাছ হতে বুবু আর আপনার কথা এত বেশী শুনেছি। বিশেষ করে মাঝে মাঝে বুবুর পাঠানো খাবার আর আপনার আর্থিক সাহায্য যে আমাদের কত সহায়। ভাগ্যিস সবুর আপনার মুখে কমান্ডার আবছারের নাম শুনে ছুটে গিয়েছিল সঠিক তথ্য জানতে না হয় কি যে হত ভাবতেই গায়ের লোম শিউরে উঠছে। রহমান সাহেব ওদের আশস্থ করেন-না না এত একটা দূর্ঘটনা। তোমরা এত লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। তখন শরীফ স্বখেদে বলে- আসলে জানেন দুলাভাই গত দুদিন আগে আমাদের এক মুক্তিযোদ্বা অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে এক রাজাকার তাকে পাক আর্মিদের কাছে ধরিয়ে দেয়। ওকে তথ্যের জন্য হাত পা কেটে এমন বীভৎস ভাবে মারা হয় যে মনটাই বিক্ষুদ্ব হয়েগিয়েছিল। তখন আবছার বলে ওঠে -–এজন্যই আমি তোমাদের কে বার বার একথাটাই বুঝানোর চেষ্টা করি রাজাকার দের মেরোনা ।ওরা তো আমাদেরই দেশের মানুষ। আজ সময়ের প্রেক্ষাপটে ওরা রাজনৈতিক ভাবে দ্বিধাবিভক্ত হলেও একদিন ওদের চিন্তার পরিবর্তন ঘটবে।

জীবন ছুটে চলে বহতা নদীর মতই। কঠিন সেই সেই বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করে মোলভী সাহেব কে নতুন করে পোড়া ভিটায় ঘর তুলতে হয়। এরই মাঝে রাজাকার কমিটির সদস্য এক ব্যক্তি এসে সহমর্মিতার হাত বাড়ান এই শোকার্ত পরিবারের প্রতি। তিনি অনেক কষ্টে অনান্য রাজাকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে মৌলভী সাহেব ও তার মেয়ের জামাইর জন্য রাজাকার কমিটির দুটো সদস্য কার্ড সংগ্রহ করে দেন। যাতে ভবিষ্যতে পাকিস্থানী আক্্রমনের বিরুদ্ধে এই কার্ড রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করে। এর মাঝে একদিন আবছার দেখা করতে এলে বুবু ওর নিরাপওার ব্যাপারে উৎকন্ঠা প্রকাশ করে। তখন আবছার তাকে আশস্থ করে বলে -বুবু তুমি আমার জন্য ভেবনা। আমার হাতে যদি একটি ব্লেড ও থাকে তবে তা দিয়ে হলেও আমি আতœরক্ষার চেষ্টা করবো ।দেশকে নিয়ে আমার বুকের মাঝে অনেক না বলা কথা অনেক গল্প জমে আছে। আমি ফিরে এসে উঠোনের এই পেয়ারা গাছটির নিচে চাঁদের আলোয় বসে সে গল্প গুলো সবাই কে শুনাবো। তখন ওর সহযোদ্বা মাশরুফ বলে উঠল – বুবু ওকে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। যাদি শত্্রুর কোন বুলেট আবছারের দিকে ছুটে আসে তবে তা প্রথমে আমাকে শেষ না করে আবছারের কেশাগ্র ও স্পর্শ করতে পারবেনা। সেদিন কি কেউ জানতো এই আবেগময় কৃতজ্ঞতার ভাষা আর বন্ধুত্বের এই সুপ্রিয় বন্ধন ও চাপা পড়ে যাবে স্বার্থের নোংরা আস্তাকুড়ের আড়ালে।

একদিন হাটবার মৌলভী সাহেব হাটে গেলেন বাজার করবেন বলে। দেখলেন লোকজন তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরছে। তিনি অবাক হয়ে একজন হাটুরে কে এর কারন জিগ্যেস করলেন। তখন সে লোক জানাল – কোথায় নাকি এক শক্তিশালী বাঘকে ফাঁদে ফেলে নিকেশ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। অগত্যা মৌলভী সাহেব বাজার করা ছাড়াই বাড়ি ফিরলেন ।কিন্তু উৎকন্ঠিত মনটা খচখচ করতে লাগলো ।দেশে এ সময় কোন সরকারই কার্যকর নেই ।তবে কে ডাকল কেনই বা ডাকল কারফিউ ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। আস্তে আস্তে চারদিক হতে মুক্তিযোদ্বাদের বিজয়ের খবর আসতে লাগলো। গ্র“পে গ্র“পে মুক্তিযোদ্বা আর ঘরছাড়া মানুষরা সব ঘরে ফিরছে। মৌলভী সাহেব আর পরিবারের সবাই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। কিন্তু একে একে ওর সাথীরা সবাই ফিরল শুধু ও ছাড়া। চারদিকে লোকজনের কানাঘুষা আর ফিসফাস শুরু হয়। পরিবারের লোকজনের প্রতীক্ষা এবার উৎকন্ঠায় রুপ নেয় । একদিন আবছারের বেশ কজন সাথী এসে মৌলভী সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে ।এদের মধ্য হতে মাশরুফ মাতম করতে থাকে পাগলের মত।-খালুজী আপনি আমাকে শেষ করে ফেলেন, আমাকে মেরে ফেলেন। ওর বিলাপে বাড়ির নারী শিশুরাও বেরিয়ে আসে। তখন ও বলে -খালুজী আবছার আর নেই। ঘাতকরা আবছারকে শেষ করে দিয়েছে। মৌলভী সাহেব শীতের শুকনো পাতা ঝরে পড়ার মত টলে মাটিতে পড়ে যান। ওদিকে মা আর বুবুর ও একই অবস্থা। আশে পাশের প্রতিবেশীরা তখন সহানুভুতি নিয়ে এগিয়ে আসে হয়তবা শহীদের ঋণ পুরনে। দীর্ঘ প্রায় বিশ দিনের ও বেশী কেটে যায় এই শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের নতুন করে পুথিবীর আলো বাতাস দেখতে ।প্রতিবেশীরা এই সময় ছোট শিশুদের এবং পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয় নিজের মনে করে। দুর দুরান্তের গ্রাম হতে ও মানুষেরা ছুটে আসে যুদ্বকালীন সময়ে আবছারের অবদানের কৃতজ্ঞতা জানাতে তার শোকার্ত পরিবারের প্রতি।স্বাধীন দেশের মাটিতে একদিন সত্যিই উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। কিন্তু সেই সুসংবাদ নিয়ে আবছার আর ফিরে আসে ।প্রতিক্ষার আশারা হারিয়ে যায় সুদুরে। বুবুর ক্লান্ত চোখের ঝাপসা দৃষ্টির কাছে সদ্য প্রসূত স্বাধীনতার সুর্যের রক্তাভা তার পুড়ে যাওয়া শাড়ির মতই বিবর্ণ মনে হয়। স্বঅনুভুতি সচল হবার পর মৌলভী সাহেবের মনে ব্যাথার ঢেউ উথলে উঠে,মনে হয় যে দেশকে স্বাধীন করতে যেয়ে আমার ছেলে জীবন দিল সেই স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বিঘা জমিও কি আমার ছেলের ভাগ্যে লিখা নেই। এক সময়ের রাস্তার বখাটেরা এখন লুটতরাজ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ ।মৌলভী সাহেব মরীয়া হয়ে ছুটে যান সেই কেউকেটা ছেলের এক সময়ের সহপাঠী মাশরুফের কাছে। যাকে এক সময় তার পারিবারিক দুরবস্থার কারনে আবছার বাবার চোখ এড়িয়ে গোলার ধান বিক্্ির করেও পড়ালিখার খরচ যুগিয়েছে। সময়ের পরিক্্রমায় সেই চেনা মুখ গুলো যেন আজ পরিবর্তনের মেকাপ পরে অচেনাবর্ণ ধারন করেছে ।যদিও তার জানা হয়ে গেছে এই সহযোদ্বারাই আতœপ্রতিষ্ঠার পথে আবছার কে হুমকি মনে করে দেশ স্বাধীনের পর পরিকল্পিত ভাবে খুন করে লাশ গুম করে রেখেছে। তিনি পিতার আকুতি নিয়ে বার বার ছুটে যান ছেলেকে একবার দেখা ও পরিপুর্ণ মর্যাদায় দাফন করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঘাতকদের মানবীয় বিবেক খানিকটা হলেও জাগ্রত হয়। অনেক শর্ত সাপেক্ষে জনতার রোষ এড়াতে মাত্র কয়েক জন লোকের উপস্থি—তিতে রাতের অন্ধকারে মুনির ব্যাপারীর খড়ের গাদার নিচ হতে তারা আবছারের লাশ বের করে দেয় ।আবার তাদেরই সতর্ক নেত’ত্বে জানাযা ছাড়াই পূর্ব হতে প্রস্তত করে রাখা জায়গায় অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে রাতের অন্ধকারেই কবর দেয়ার ব্যবস্হা করা হয়। একদিন আতœপ্রত্যয়ী যে তরুন শুধূমাত্র মাত’ভুমির প্রতি ভালবাসাকে সম্বল করে রাতের অন্ধকারে পাড়ি দিয়েছিল অজানার উদ্দেশ্যে নিজ ঠিকানা ছেড়ে, নিয়তির নির্মম পরিহাসে আজ তার বিদায় অভিষেক ও হয় রাতের অন্ধকারে একাকীই সংগোপনে ।
জীবন ব্যস্ততাময় সময়ের ঘোরে ডুবে গেলেও বুবুর স্নেহাতুর হূদয় ঠিকই খুঁজে ফেরে সহোদরের স্মূতি। তার ব্যাথাতুর মন একাকী হাঁটে নির্ঘুম স্মুতির পথে। কখনও নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পেয়ারা তলায় কখনও বাড়ির পাশ দিয়ে একে বেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ ধরে,যেপথের ধুলোয় জড়িয়ে আছে দুভাই বোনের অনেক স্ম,ুতি। মাঝে মাঝে বুবু ঘুমের মাঝে খোকা ভাই, খোকা ভাই বলে চিৎকার করে ওঠেন,ছুটে যান উঠোনে ।কিন্তু সবই শুন্য সুনশান। বুবুর মতই কারো আগমনের প্রতীক্ষায় আশাহত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা পেয়ারা গাছটির নিচেও যে বিরাজ করছে কেবলই শূন্যতা। শুধু রাতের জোনাকিরাই যেন নিভু নিভু হয়ে আসা সেই প্রতীক্ষার সলতেতে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। বুবুর মন উচাটন হয়ে ওঠে বারে বারে না জানি ছোট ভাইটি অনেক না বলা কথার ভান্ডার নিয়ে শ্রোতাহীন পেয়ারা তলা হতে অভিমানে ফিরে গেছে।
দেশ স্বাধীন হবার বেশ কিছুদিন পর একদিন রহমান সাহেব ফিরছেন চাটগাঁ হতে গ্রামে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে চারদিক আঁধার করে রাত নামে। দেশের আইন শূংখলা পরিস্থিতি ভাল নয় বলে তিনি সাত পাঁচ ভেবে সিদ্বান্ত নিলেন আজ রাতটা কোন মতে স্থানীয় থানায় কাটিয়ে সূযের আলো ফুটলে বাড়ির পথ ধরবেন ।তিনি থানা অফিসারের কাছে গিয়ে সমস্যাটা খুলে বলে রাতের মত সেখানে আশ্রয় নিলেন। নতুন থানা অফিসার বেশ মিশুক প্রক’তির লোক। বেশ আপত্তি করা সত্বেও চা আনালেন এত রাতে। কথায় কথায় প্রশ্ন করলেন -কোন বাড়ি যাবেন আপানি? রহমান সাহেব বললেন – ফরাজি বাড়ি। থানা অফিসার বিস্ময়ের সাথে বললেন -আপনি কি কমান্ডার নুরুল আবছার কে চিনেন। রহমান সাহেব বিষন্ন গলায় বললেন -আমি ওর দুলাভাই। থানা অফিসার উঠে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগের সাথে বললেন- –আমি যদিও এ এলাকায় নতুন তারপরও এলাকার লোকজনের কাছে আমি কমান্ডার আবছারের বীরত্বের কথ্া শুনেছি। এত কম বয়সী এই তরুনের ঘটনা শুনে আমি আমার আবেগ কে ধরে রাখতে পারিনি। তিনি হাত ধরে রহমান সাহেব কে থানা অফিসের একটি দেয়ালের সামনে টেনে নিয়ে যান। দেয়ালে অনেক গুলো দাগ দেখিয়ে বলেন -আপনি জানেন কমান্ডার আবছার কে এ স্থানটিতেই গুলি করা হয়। ঘাতকের সব গুলো বুলেট উনি অপুর্ব দক্ষতার সাথে পাশ কাটাতে পারলেও শেষের দুটি গুলি উনার কপালে গর্ত করে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায় ।ঠিক এই জায়গার মেঝেতে উনি লুটিয়ে পড়ে যান। স্বাধীনতার খবর নিয়ে তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। জানেন দেশের আইন শূংখলা পরিস্থিতির কারনে মাঝে মাঝে যখন আমি মাঝ রাত পর্যন্ত থানায় কর্তব্যরত থাকি তখন আমার আবেগ তাড়িত মন আমাকে এই জায়গায় টেনে নিয়ে আসে। তখন আমার মনে হয় আমি যেন কারো গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজ শুনি। আবেগে অফিসারের গলা ধরে আসে।
সেদিন শহীদের বিচারের দাবী নিভূতে কেঁদেছে কিন্তু একজন সন্তান হারা পিতা ব্যর্থ হয়েছিলেন সুবিচার পেতে। দেখতে দেখতে স্বাধীনতার জন্মলগ্ন পেরিয়ে সময়ের সুতোটা বরাবরই দীর্ঘ হয়েছে কিন্তু আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে সেই বিচার। হয়তোবা জাগতিক আদালতের চাইতে বড় কোন আদালতে দুনিয়ার বিচারকদের চাইতেও অনেক বড় শ্রেষ্ঠ যে বিচারক তার দরবারে মীমাংসার অপেক্ষায়। যৌবনের শুরুতে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর যে তরুন এভাবে তার সর্বস্ব বাজি রেখে ছুটে গিয়েছিলেন দেশকে পরাধীনতার শূংখল থেকে মুক্ত করতে অবশেষে খুইয়ে ছিল নিজের মূল্যবান জীবনও না তাকে নিয়ে আজ পর্যন্ত রাষ্টীয় কিংবা সামাজিক ভাবে নির্মিত হয়নি কোন স্মুতিফলক। বরং মাঝে মাঝে শহীদের পরবর্তী প্রজন্মকে দেশে প্রবাহমান কুলষিত রাজনীতির কারনে রাজাকার উপাধিও নিরবে হজম করে নিতে হয়। তবে সান্তনা শুধু এ্টাই শহীদ হয়তো আজীবন বেঁচে থাকবেন কাছে কিংবা দুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার প্রিয়জনদের স্মরণে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। হয়তোবা আতœত্যাগী এই তরুনের একাত্তরের বিজয় গাঁথা গ্রামবাসীদের কাছে আজ ঝাপসা হয়ে ধুলোর আস্তরন পড়ে যাওয়া ছবির ফ্রেমের মতই বিবর্ণ কোন স্মৃতি। তার কবরে উর্কীণ ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মুৃতিফলকের এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন মুক্তিযোদ্বা কমান্ডার নুরুল আবছার লেখাটিও কালের স্্েরাতে আজ বেশ ঝাপসা হয়ে নবীন প্রজন্মের কাছ হতে অভিমানে গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু আজও বুবুর লাগিয়ে দেয়া শহীদের প্রিয় শিউলি গাছটি হতে প্রতি শরতে শিউলিরা ঝরে পড়ে তার কবরের উপর শিশিরের কান্না বুকে নিয়ে।

সম্পুর্ন সত্য একটি ঘটনাকে গল্পের মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম। জানিনা পাঠকদের কাছে কেমন লাগবে। আমি যখন আমার আট বছরের মেয়েটিকে ওর স্কুলের ন্যাশনাল ডে তে বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে দিয়ে ওকে স্বাধীনতার ঘটনা গুলো বলছিলাম এবং এরই পরিক্্রমায় পারিবারিক এই ঘটনা টি ও বললাম তখন ও আমাকে জিজ্গেস করলো -মা উনি শত্র“র হাতে জীবন হারালেন না অথচ উনার সহযোদ্ব¢াদের হাতেই জীবন দিলেন? আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এ একই প্রশ্ন? তো আমি আমার শৈশবে আমার মাকে করেছিলাম। অবশেষে আমি আমার এ না পাওয়া প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলাম মেজর জলিল রচনাবলীতে। পাঠকদের জন্য এ বইয়ের সামান্য উদ্বৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। (যশোর সেনা ছাউনীর অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে সকাল এগারোটায় বন্দী করা হয়। বাড়ী না যেন হানাবাড়ী। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশেপাশে বেশ কিছু নরকঙ্কাল পড়ে আছে। ঘরের রুমে মানুষের রক্তের দাগ। কোন ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমি হলাম প্রথম রাজবন্দী।) এর পরিপেক্ষিতে এমাজউদিদন আহমদ লিখেছেন (যে ঘরে সেদিন মেজর জলিল বন্দী অবস্থায় ছিলেন তা কি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে স্বতন্ত্র কিছু? সে ঘরটাই তো আজকের বাংলাদেশ।)‘ স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আজও আমাদের যাদের অনেক কিছু জানার বাকি আশা করছি বইটি তাদের কাছে সুখপাঠ্য হবে ।ইতিহাস যেন শাশ্বত সত্যের রোশনাই নিয়ে আলোকিত করে আমাদের প্রতিদিনকার চলার পথ ।কারো ক্ষমতার দম্ভে যেন বিকৃতি না ঘটে এর চিরন্তন পথ চলায়। এ প্রত্যাশায় পাঠকদের নিরন্তন শুভেচ্ছান্তে লেখিকা।

লেখিকা – মুক্তিযোদ্ধা আফছারের ভাগনি নুর আয়েশা সিদ্দিকা/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *