গণমাধ্যম কেন সহিংসতার শিকার -বাংলার দর্পন ডটকম

দেশদ্রোহী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শিকার হচ্ছে গণমাধ্যম। শিকার হচ্ছেন সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার এবং টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানরা। তাঁরা দেশের সেবায় জনগণকে জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি- সব বিষয়ে অবগত করছেন তাৎক্ষণিক টিভির মাধ্যমে। সংবাদপত্র সুদীর্ঘকাল থেকেই সবিস্তারে তৎপর সমাজের দর্পণ হিসেবে, যেখানে ছোট-বড়, উল্লেখ্য-অনুল্লেখ্য ঘটনাপঞ্জির জাবেদা খাতার ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঘটনার বিবরণ, বিশ্লেষণ ও গুণাবলি বিচার করে সত্যনিষ্ঠ ও বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরাই লক্ষ্য এবং এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার প্রমাণ রেখে এসেছে বলে গণমাধ্যম আজ জনগণের কাছে বিপুল জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া প্রচারের বিষয় হিসেবে রয়েছে নাচ, গান, নাটক, রিপোর্টাজ, সাক্ষাৎকার ও যেকোনো প্রসঙ্গ নিয়ে কাটাছেঁড়া করার ‘টক শো’ সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ছাড়াও রয়েছে বেতার- প্রচলিত রেডিও ও এফএম বেতার সম্প্রচার। এরও একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। গণমাধ্যম আজ অতিসহজেই সাধারণ মানুষের কাছে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে তাৎক্ষণিক ও দ্রুত পৌঁছে যায়। তাই জনমত সংগঠনে গণমাধ্যমের বিস্তৃত ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জমানায় আজকাল সকালে পত্রিকা যেসব খবর নিয়ে বেরোবে অনলাইনে তার ত্বরিত সংস্করণ টেলিভিশনে মধ্যরাতেই প্রচার হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে যারা গণবিরোধী চক্র, এ দেশের অভ্যুদয়কে ঠেকাতে ভিনদেশি শাসকদের ভাড়াটে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই পরাজিত ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তো আছেই, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীরাও গণমাধ্যমকে ভয় পায় প্রচণ্ড। সে কারণেই গণমাধ্যমের ওপর কুটিল নজর, তাদের সঙ্গে হিংসাত্মক আচরণ অহরহ ঘটছে। ফলে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও ক্যামেরাম্যানরা নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছেন। শুধু কি তাই? গণমাধ্যমে এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন নারী সাংবাদিকরা, আজ তাঁরাও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির টার্গেট। কারণ এ দেশের এই অপশক্তির উত্থানও প্রবল হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। আজ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির আস্ফালন এই গণমাধ্যমের কর্মী-সংগঠকদের ওপর। তাই ইদানীং আহূত সহিংস হরতালে অবধারিতভাবেই পুলিশের মতো গণমাধ্যমজনরাও টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। দেখে দেখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তাৎক্ষণিক পরিবেশন ও ঘটনাপঞ্জি নিত্য-বিশ্লেষণকারী টক শো এবং পত্রিকার খবর ও খবরের পেছনের খবর লেখকদের ওপর রোষ হরতালকারীদের। যাঁরা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করেন, তাঁদের ওপরই হামলা করে ওই হিংস্র মৌলবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী তাণ্ডবকারীরা। তাই তো গত হরতালেও দেখলাম, আগের মতোই গণমাধ্যমও হিংস্র সহিংসতার শিকার হয়েছে। যেসব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে, তাদের রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান-ফটোগ্রাফার হরতালকারীদের হাতে লাঞ্ছিত হন, আহত হন; এমনকি খুনও যে হন না, তা বলা যাবে না। তাই তো দেখি ৭১ টিভি, চ্যানেল ২৪, দেশ টিভি, এটিএন, এমনকি আরটিভিও আক্রান্ত হয়েছে। ৭১-এর নিউজরুম এডিটর জাকারিয়া বিপ্লব বোমা হামলায় গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে আজও শয্যাগত। ২৪-এর রিপোর্টার রাশেদ নিজাম ও ৭১-এর একজন রিপোর্টার ওই টার্গেটের শিকার হয়েছেন। ভোরের কাগজের সামনে দু-দুবার বোমা হামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশ টিভিও একই ভবনে অবস্থিত। এর আগে আরো এমন ঘটনা হয়েছে। হেফাজত একজন সাহসী নারী সাংবাদিককে পিটিয়ে দারুণ আহত করতেও দ্বিধা করেনি।
আবারও হরতাল আসছে, বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দুই পক্ষের একগুঁয়েমির ফলে এমন হরতাল, বিক্ষোভ, অবরোধ চলতেই থাকবে। তাই ভাবছি, আবার কতজন সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান জখম হবেন, পঙ্গু হয়ে যাবেন জীবনের তরে?
ক্রমশ বেড়ে চলা এই সহিংসতার শিকার সাংবাদিকরা হলেও তাঁরা ‘যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক’; তাঁদের লড়াই জনগণকে পরিস্থিতি জানান, ঘটনাবলি তুলে ধরা, যত নির্যাতনই হোক, তাঁরা এ থেকে দূরে থাকবেন কী করে? সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমে যে পক্ষ-বিপক্ষ নেই, তা তো বলা যাবে না। সুতরাং সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে তাঁদের, যাঁরা দেশের রাজনীতির অঙ্গনে আছেন, কি ক্ষমতাসীন, কি ক্ষমতাপ্রত্যাশী- সবাইকেই।
এসবের প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি সবাই এক হয়ে বলতেন, আমরা আর হরতাল বা বিরোধী কার্যক্রমের খবর তুলে ধরব না, তাহলে কী হবে- একবার ভেবে দেখেছেন কি পক্ষ-বিপক্ষ? রাজনীতির কুশীলবদের এই অনুরোধ করি, তাঁরা যেন সাংবাদিকদের ওপর এমন হিংস্রতা না দেখান। তাঁদের ওপর ঘৃণ্য আক্রমণ না চালান। কেউ কেউ হয়তো উস্কানি দেয়, ইন্ধন জোগায়, তাতে যেমন গণমাধ্যম উত্তেজিত হয় না, তেমনি ব্যবহার গণমাধ্যমও অন্যদের কাছ থেকে আশা করে না। এই যে ‘জ্ঞানপাপী’ ও অতি বাম থেকে মৌলবাদী ‘চিন্তাবিদ’-এ পরিণত হয়ে ফরহাদ মজহার গণমাধ্যমকে যেভাবে দোষারোপ করে হরতালকারীদের উস্কে দিলেন- ‘এত কম কেন, আরো বোমা মারতে হতো’ বলে নির্দেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে বিএফইউজে, সংশ্লিষ্টরা সোচ্চার হয়েছে এবং একজন সাহসী সাংবাদিক তাঁর বিরুদ্ধে জিডিও করেছেন। এমন বক্তব্য টেলিভিশনে বসে (অবশ্য একুশে টিভি) যে ধরনের কুৎসিত মন্তব্য ও উস্কানি দিয়েছেন, তাতে সরকারের কি কিছুই করণীয় নেই? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আবার তাঁকে সাহস দিয়ে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে বিএনপি আছে। এটা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক স্টান্ট ও সরকারবিরোধী প্রচারণা।
সব সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল যে ‘গঙ্গার জলে ধোয়া তুলসী পাতা’, তা বলছি না। তবু গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা আছে, তাতে স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই বলা যায় না, লেখাও যায় না। পাকিস্তান জমানায় আমরা সাংবাদিকরা একাট্টা ছিলাম, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ঐক্য ভাঙতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আমরা দ্বিধাবিভক্ত। তাই আজ সাংবাদিকদের দাবি উপেক্ষিত এবং কোথাও কোথাও নৈতিকতায়ও স্খলন লক্ষ করা যায়। ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট বা পেশাদার সাংবাদিকরা কেন দলীয় মনোভাবে আপ্লুত হবেন? সাংবাদিকতার নীতিমালা সমুন্নত রাখতেই হবে, এ কথা সর্বদা স্মরণীয়। আর ‘প্রতিপক্ষ’ যাঁরা হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বলি, গণমাধ্যমে হামলা ও সাংবাদিক নিপীড়ন বন্ধ করুন।

লেখক : সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *