দূর্গম পাহাড়ে আলোর মশাল : ডাঃখালিদ আল আজম সাদা মনের মানুষ

 


আব্দুর রহিম :- এই ঘুনেধরা স্বার্থপর পৃথিবীতে,নিঃস্বার্থ পরোপকারী মানুষগুলোর সংখ্যা দিনকে দিন কমে গেলেও,মাঝে মাঝে যাদের দেখা মিলে,সত্যিই তারা আমাদের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা বিবেকের দুয়ারে নাড়া দেয়।

কিছু মানুষ এখনো পৃথিবীতে এমন আছে,যারা কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবেনা। যাদের ভাবনায় থাকে, কিভাবে নিরিহ,নিষ্পেশিত,সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর সেবা করা যায়।তাদের মুখে একটু হাঁসি ফুটানো যায়।
যারা অন্যের কল্যানে বিলিয়ে দেয়,নিজের জীবন,যৌবনের মূল্যবান সবটুকু সময়।এ দূর্লব ক্ষনজন্মা মহান মানুষগুলোর মত,এমনই একজন নিঃস্বার্থ সাদা মনের মানুষ ডাঃ খালিদ আল আজম।
১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার মনোহরদি ইউনিয়নের রাধা নগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।প্রাথমিকের গন্ডি পাড়ি দেন একই উপজেলার ছয়ঘড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।১৯৭৭ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার ঘোষবিলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি।

অতপর স্বপ্ন পূরণের যাত্রা,ঐ সময় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে ভর্তি হন এমবিবিএস,ডিগ্রি অর্জনের জন্য।১৯৮৫ সালে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
মা- বাবার তৃতীয় সন্তান তিনি।বাবা বজলুর রহমান ঘোষবিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের আজীবন প্রধান শিক্ষক।১৯৮৮ সালে কর্মরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা যান।
কিন্তু কে জানতো? সদ্য এমবিবিএস পাস করা এ ছেলেটির ভিতরেই লুকিয়ে রয়েছে আজকের এ মহান পরোপকারি মানুষটির সত্ত্বা।
এমবিবিএস পাস করার পরও কর্ম জীবন শুরু করার জন্য ছুটেনি কোন লোভনীয় চাকরীর পিছনে। সারা জীবন প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের  সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে থাকার,তাদের সেবা করার সুপ্ত আকাংখা মনের ভেতর লালিত করায়,তৎকালিন সময় সরকারী স্বাস্থ্য কেডারে যোগদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি যোগদান করেননী।
১৯৮৮ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গ্রামীন স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী ইসলামিক মিশনে। চষে বেড়ান পটুয়াখালির প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল,ছোট বিঘা,গাজিপুরের ভাংনাহাট,কুড়িগ্রামের ধরনি বাড়ি,নড়াইলের হাটবাড়িয়া সহ আরো অনেক স্থান।অর্জন করেছেন,সুনাম আর দক্ষতা।
২০১৩ সালের জানুয়ারী মাস,এবার যেন তাঁর স্বপ্ন ছোঁয়ার পালা।খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া ইসলামিক মিশনে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন তিনি। যোগদানের পরপর তিনি দেখলেন এই দূর্গম পাহাড়ি এলাকার হতদরিদ্র মানুষগুলো রোগে-শোকে পায়না কোন ভাল মানের চিকিৎসা।কিছু প্রাইভেট প্রাকটিসে কিছু ডাক্তার থাকলেও, প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে না পারায় তারা চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। এ সকল দৃশ্যগুলো তাঁর মনের গভীরে দাগ কাটে। তাই তিনি এ অবহেলিত সুবিধা বঞ্চিত,দরিদ্র মানুষ গুলোকে  চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য ছুটতে লাগলেন এই দূর্গম পাহাড়ের গ্রাম থেকে গ্রামে। এ মহান মানুষটির কাছে কখনো আর্থিক বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেনি।
প্রাইভেট প্রাকটিসের সময়,যখন যে রুগি তাঁকে ভিজিট হিসেবে,  যা দিতে পারে তাতেই তিনি সন্তষ্ট। কেউ যদি ভিজিট নাও দিতে পারে তবুও তাঁর মুখে লেগে থাকে একরাস মিষ্টি হাসি।রাতের গভীরে এসেও যদি কেউ তাঁর দরজার কড়া নেড়ে বলে,তার সাথে এক্ষুনি যেতে হবে, যত প্রতিকুল পরিবেশই থাকুকনা কেন,তিনি ছুটে চলে যান।তাঁকে কখনো আটকাতে পারেনি,দূর্গম পাহাড়ের অন্ধকার জঙ্গল,আটকাতে পারেনি মাইলকে মাইল পিচ্ছিল কাঁদা মাখা রাস্তা। নিজের জীবনের মায়া তিনি কখনো করেননি।তার কাছে রুগির সেবা করাটাই সবার উর্দ্ধে।
তাঁর এই মহত্ত্ব,ভালবাসা,উদারতা আর গরীব মানুষ গুলোর জন্য কিছু করতে পারার মানুষিকতা তাঁকে করেছে,এই দূর্গম পাহাড়ি এলাকার  পাহাড়ি-বাঙ্গালির ভালবাসার মধ্যমনি।পাহাড়ি- বাঙালী,ছোট- বড় সবার হৃদয়ে ভালবাসার আসনটা তিনি ঠিকই করে নিয়েছেন।
এসকল সেবা মুলক কাজে তাঁকে যে ছায়ারমত পাশে থেকে সহযোগিতা করে,অনুপ্রানিত করে,তিনি হলেন তাঁর সহধর্মীনি খোরসেদা খাতুন(৫০)
শুধু মানব সেবাই তিনি আটকে থাকেননি,এর পাশা-পাশি বাংলা সাহিত্যেও তিনি অবদান রেখেছেন। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিনটি বই।
১/খোলা বাতায়নে অতৃপ্ত দখিনা হাওয়া।
২/সংখ চিলের স্বপ্ন যাত্রা।
৩/ সুখের দুয়ারে কষ্টের বিবর্ণ অভিষেক।
প্রাইভেট প্রাকটিসে যা আয় করেন তা তিনি ব্যায় করেন,এতিম দুঃস্থ্যদের লেখাপড়া,মসজিদ মাদ্রাসা পরিচালনা ও অ-স্বচ্ছল  পরিবারের সহযোগিতায়।
এভাবেই চলছিল তাঁর পাহাড়ি চাকুরী  জীবন।
হঠাৎ সুখের আকাশে একখন্ড মেঘ, ভাগ্য যেন আর সইলোনা।বিধি বাম হলে যা হয়,এই সুবিধা বঞ্চিত পাহাড়ের মানুষ গুলোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তাদের বিপদের একমাত্র আস্রয়স্থল ডাঃখালিদ আল আজম’র (০২/০৫/২০১৭)ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলায় বদলির আদেশ আসে।
এখবর মেনে নিতে পারেনী স্থানীয় জনতা।মূহুর্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে পাহাড়ী জনপদ।শুরু হয়ে যায় তাঁর বদলি প্রত্যাহারের জন্য মিটিং মিছিল, মানববন্ধন।
বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া,টেলিভিশন চ্যানেল তাঁর বদলি প্রত্যাহার চেয়ে অনেক সংবাদ পরিবেশন করে।কিছুতেই কিছু হয়নি অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে যান তাঁর নতুন কর্মস্থলে।
কিন্তু শ্রষ্টা যার মনের গভীরে দুঃস্থ্য,নিরিহ,দরিদ্র মানুষ গুলোর জন্য ভালবাসার বীজ বপন করে দিয়েছে,তাঁকে আটকাবেকে? সপ্তাহে,মাসে যখনি তিনি ছুটি পান,তখনি ছুটে আসেন সুদূর ঝালকাঠি থেকে দূর্গম পাহাড়ের বুকে।ছুটে চলেন,গ্রাম থেকে গ্রামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *