আনোয়ারুল হক আনোয়ার : মিয়ানমারের আরাকান ও রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন সমানগতিতে চলছে। মিয়ানমারের চলমান ঘটনাবলীর সাথে সত্তর ও আশির দশকে সংঘঠিত ইসরাইলী সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনী নিধন ও বিতাড়নের ঘটনাটি একই সূত্রে গাঁথা। আরব ভূমি থেকে ফিলিস্তিন নির্মূলে ইসরাইল যে সব পদ্বতি গ্রহন করেছিল – ঠিক তেমনিভাবে মিয়ানমার সরকারও একই পদ্বতি বাস্তবায়ন করছে। সে সময় তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত কয়েকটি মুসলিম দেশ এবং সমাজতান্ত্রিক বন্ধু দেশগুলো ইসরাইলী বাহিনীর কর্মকান্ডের বিরুদ্বে সোচ্চার ছিল। ফলে এবারের রোহিঙ্গা ইস্যুতেও একই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রভাবশালী মুসলিম দেশ এবং ধনাঢ্য রাজা বাদশা শাসিত আমাদের জ্ঞাতি ভাইয়েরা মুখে তালা ঝুলিয়েছে। অবশ্য এর কারনও নিহিত রয়েছে। মিয়ানমারের নব্য মিত্র পশ্চিমাদের ভয়ে প্রভাবশালী মুসলিম দেশ ও রাজা বাদশারা কিছু বলতে সাহস করছেনা। ফলে ফিলিস্তিনের ন্যায় মিয়ানমারেও যা হবার তাই ঘটছে। এক কথায় যাহা লাউ – তাহাই কদু।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশ্ববর্তী বাংলাদেশ হুমকির সন্মুর্খীন। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে মানবিক কারনে আশ্রয় দেয়া ছাড়াও প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন সমস্যার সন্মুর্খীন হচ্ছে বাংলাদেশকে। এদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও রোগিঙ্গা ইস্যুতে নীরব ভূমিকা পালন করছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষিত হলেও আমাদের দেশের নারীবাদী সংগঠনগুলো চোখ বুঁজে রয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমা সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে। মিয়ানমারের ঘটনাবলীতে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিন্তান, ভারতের কলকাতা ও তুরস্কসহ কয়েকটি দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ফলোদয় হয়নি। প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা নরনারীকে নির্মম কায়দায় হত্যা নির্যাতন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা নিশ্চুপ। কয়েকদিন আগে পশ্চিমা সমর্থিত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মিয়ানমার সফর শেষে মন্তব্য করেন যে, ”রোহিঙ্গা হত্যাকে গনহত্যা বলা যাবেনা “। কি কলে গনহত্যা বলা যাবে – অবশ্য সেটা তিনি উল্লেখ করেননি। সচেতন পাঠকগন, এবার বুঝে নিন সভ্য নামধারী বিশ্ব সংস্থার আচরন।
অপর একটি খবরে জানা গেছে , সৌদী আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্ক আমেরিকা থেকে সাতশত বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ সাত হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। এ চারটি দেশের সাথে আমেরিকা,পশ্চিমা দেশ এবং ইসরাইলের মধুর সখ্যতা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কার বিরুদ্বে এসব মারনাস্ত্র ব্যবহৃত হবে ? না কি মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য বন্ধু দেশগুলো সাত হাজার কোটি ডলারের মারনাস্ত্র ক্রয়ের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মার্কিনীদের সহযোগীতা করছে। উল্লেখ্য, সাত হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি সম্পাদনের সাথে সাথে অন্তত দেড় লাখ মার্কিনীর নতুন কর্ম সংস্থানের সূযোগ সৃষ্টি হবে। অথচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে এসব দেশে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। অথচ সিরিয়া গৃহযুদ্বে এসব দেশের লাফালাফি পরিলক্ষিত হলেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা নীরব। উল্লেখিত চারটি দেশের উচিত ছিল, রোহিঙ্গা শরনাথীদের পূর্ণবাসনে জরুরী ভিত্তিতে আর্থিক সহযোগীতা প্রদান করা। কিন্তু আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্ধ এবং কর্তৃক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ রয়েছে এসব দেশ।
তৎকালীন বার্মা এবং বর্তমান মিয়ানমারে ১৯৯১ সাল থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন শুরু হয়। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতার সূযোগটি গ্রহন করে মিয়ানমারের জালিম সরকার এবার চরম আঘাত হানছে সে দেশের একটি নীরিহ সংখ্যালঘু জাতির উপর। ফলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন বন্ধ হবেনা। বৌদ্ব ধর্মাবলম্বীরা বলে থাকে, ”বৌদ্ব ধর্ম নাকি শান্তির ধর্ম”। জীব হত্যা নাকি মহাপাপ। আমার প্রশ্ন, কোথায় গেল বৌদ্বদের কথিত শান্তির শ্লোগান। বৌদ্ব ধর্মগুরু ও আধ্যাত্নিক নেতা দালাইলামা রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরবতা পালন করে আসছে। তিব্বত থেকে বিতাড়িত এই বিতর্কিত ধর্মগুরু মূলত: পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। বিষয়টি আাঁচ করতে পেরে চীন সরকার অনেক আগেই দালাইলামার বিরুদ্বে কঠোর অবস্থান গ্রহন করে। দালাইলামার নোবেল প্রাপ্তিতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমারের আরেক শয়তান অং সাং সুকিও পশ্চিমা এজেন্ট। পশ্চিমাদের আশির্বাদে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে সে। কিন্তু তার দেশে রক্তগঙ্গা বইলেও সে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্বে অবস্থান নিয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর দূর্বলতার সূযোগে রোহিঙ্গা ইস্যুর সন্তোষজনক সমাধানের সম্ভাবনা আমি দেখছিনা। বরং মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন অব্যাহত থাকবে। কারন, গত আড়াই মাসে মুসলিম দেশগুলো মিয়ানমার সরকারের একটি পশমও স্পর্শ পারেনি। ভবিষ্যতে কি করবে সেটাও আমার জানা আছে। বিশ্ব মানচিত্রে মিয়ানমার এমন কোন আহামরি দেশ নয় যে, তার দাপট কিংবা প্রভাবের নিকট মুসলিম দেশগুলো নতি স্বীকার করবে। মিয়ানমারকে সাইজ করতে খুব বেশী প্রস্তুতিরও প্রয়োজন মনে করিনা। আরব লীগ কিংবা ওআইসি মিয়ানমার সরকারকে হত্যা বিতাড়ন বন্ধে ৪৮ ঘন্টার একটা আল্টিমেটাম প্রদান করলে সে সরকারের টনক নড়বে। যদি তাতেও কাজ না হয় – তখন সীমিত আকারের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। সামরিক দিক থেকে মিয়ানমার তেমন কোন শক্তিশালী দেশ নয়। এমনকি সে দেশের সেনা বাহিনীর যুদ্ব ক্ষমতার রেকর্ডও ভাল নয়। মিয়ানামারের রেহিঙ্গা মুসলিম ইস্যু অন্য কোন শক্তি কখনো এগিয়ে আসবেনা। অতীতের ঘটনাবলী তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। সুতরাং এখনো সময় আছে। মিয়ানমারের জালিম সরকারের বিরুদ্বে রুখে দাঁড়ানো। অন্যথায় মিয়ানমারের দেখাদেখি অন্যান্য দেশেও মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার ইনকিলাব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক