বাংলার দর্পন ডটকম :
বাইছা লন—এক শ, দেইখা লন—এক শ, আর পাইবেন না—এক শ, ফুরাইয়া গেল—এক শ।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের ফুটপাতে পাঞ্জাবি বিক্রি করতে কয়েকজন হকার এভাবে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণে উচ্চ স্বরে দাম হাঁকাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন পথচারীদের পাঞ্জাবি কেনার সুযোগ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানাচ্ছিলেন। বাকি সবাই একসঙ্গে কণ্ঠনালি ফাটিয়ে অভিন্ন সুরে পাঞ্জাবির দামের কথা বলছিলেন। হকারদের স্লোগানে ‘এক শ’ শব্দটি অপরিবর্তিত। এই অপরিবর্তিত এক শ শব্দের জায়গায় ‘ঢাকায়’ বসিয়ে কিছু শব্দ যোগ করে আরেকটি ছন্দময় স্লোগান দাঁড় করালে যুগ যুগ ধরে রাজধানীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আগমনের হেতুসংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে ওঠে। চিত্রটি এ রকম: ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকায়, ভালো চাকরি—ঢাকায়, ভালো নিয়োগ—ঢাকায়, ভালো বদলি—ঢাকায়, ভালো বাণিজ্য—ঢাকায়, ভালো চিকিৎসা—ঢাকায়। ঢাকায় থাকলে সামাজিক স্ট্যাটাসও নাকি বাড়ে! অনেক দিন পরপর আমরা গ্রাম ঘুরে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিয়ে লিখি, আমার গর্ব, আমার অহংকার। কিন্তু গ্রাম দূরে থাক, মফস্বল শহরেও আমরা থাকতে চাই না। সবাই ঢাকায় আসতে চাই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমাদানকারী মোট উচ্চবিত্তের ৭৫ শতাংশই ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁদের প্রত্যেকের সর্বনিম্ন œসম্পদের পরিমাণ সোয়া দুই কোটি টাকা। ঢাকার বাইরে মোট উচ্চবিত্তের একমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ বসবাস করেন। বাকি সব বিভাগে উচ্চবিত্তের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কোনো জরিপ ছাড়াই বলা যায়, ঢাকায় বসবাসকারী উচ্চবিত্তদের সিংহভাগই জন্মসূত্রে অন্যান্য বিভাগের লোক। বন্দরনগর চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী এক সেমিনারে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম দিনে দিনে গ্রামে পরিণত হচ্ছে।
যুগ যুগ ধরে যদি কোনো রাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের জন্য কেবল কেন্দ্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে না। আমাদের দেশে বিকেন্দ্রীকরণ তো হচ্ছেই না, বরং এখন কেন্দ্রীয়করণ আরও জোরদার হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কর্মসংস্থানের জন্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সমতাভিত্তিক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করছে। আর বাংলাদেশে বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থিত বিভিন্ন সংস্থার প্রধান কার্যালয় এখন ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। যে সরকারি বাহিনীর সব কর্মকাণ্ড সমুদ্রের তীরে তারও সদর দপ্তর ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে। এ দেশের আইনপ্রণেতাদের অধিকাংশই বছরের বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকেন; অনেকে ঢাকারই বাসিন্দা। মাঝে মাঝে তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান।
পৃথিবীর বিভিন্ন বসবাসযোগ্য নগরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান যে একেবারেই নিচের দিকে, সেটা গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে। এখানে বাতাসে সিসা ও অন্যান্য দূষণ-উপাদানের পরিমাণ বেশি। এই মহানগরে পানির সমস্যা, গ্যাসের সমস্যা, যানজটের কারণে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। নিয়ম-নীতিহীন লাগামছাড়া বাড়িভাড়াসহ বহুবিধ সমস্যা এই মহানগরে। গ্রামে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অসম মুনাফা বণ্টনব্যবস্থা এবং নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এ বছর হাওর অঞ্চলের বোরো ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে কত দরিদ্র মানুষ ঢাকায় এসে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে বা নিচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করা উচিত।
চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশই অগ্রাধিকার দেন ঢাকাকে। ঢাকার বাইরে নিয়োগ হলে অচিরেই ঢাকায় বদলি হওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির শুরু করেন। মন্ত্রী বা সচিবের সামনে বদলির দরখাস্ত হাতে দাঁড়িয়ে করুণ চাহনিতে বলেন, ‘স্যার, আর কত দিন ঢাকার বাইরে থাকব?’ অবশেষে একদিন আরাধ্য বদলি চূড়ান্ত হলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পরিচিতদের বলেন, ‘একটা ভালো খবর আছে। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় যাচ্ছি।’ অনেকের ক্ষেত্রে বিষয়টা যতটা না প্রয়োজনের, তার চেয়ে বেশি মানসিকতার। ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ কিছু ভালো স্কুল-কলেজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকের কর্মস্থল ঢাকার বাইরে। তাঁরা ছেলেমেয়ের ভালো পড়াশোনার জন্য পরিবার রেখেছেন ঢাকায়। এত বছরে আমরা ঢাকার বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজ নির্মাণ করতে পারিনি।
যেখানে মানুষজন বেশি, সেখানে ব্যবসার প্রসার বেশি—বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অপরিকল্পিতভাবে অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে ঢাকায় ও এর আশপাশে। দেশে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে হলেও ৯২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধিকাংশই ঢাকায় অবস্থিত। ঢাকার বাইরে অবস্থিত সব বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদেরও কর্মসংস্থানের জন্য গন্তব্যস্থল ঢাকা। ঢাকায় যাঁরা চাকরির সুবাদে ভাড়াটে হিসেবে থাকেন, তাঁদেরও লক্ষ্য থাকে এখানে নিজের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করা।
বিকেন্দ্রীকরণে ব্যর্থতার দায় শুধু সরকারের ঘাড়ে চাপালে হবে না। বেসরকারি খাতের দায়ও কম নয়। যাঁরা কলকারখানা স্থাপন করেন, নানা ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে শিল্প স্থানান্তরের সরকারি উদ্যোগেও তাঁরা সহযোগিতা করতে চান না। তার একটা বড় দৃষ্টান্ত চামড়াশিল্প ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের সরকারি উদ্যোগ। পর্যাপ্ত জায়গা–জমিসহ নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা দেওয়ার পরও চামড়াশিল্পের মালিকেরা হাজারীবাগ থেকে তাঁদের কারখানা সাভারের নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তরে বছরের পর বছর ধরে গড়িমসি করে আসছেন। এমনকি এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশও তাঁরা মানতে চাইছিলেন না। শেষ পর্যন্ত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর তাঁরা ধীরে ধীরে স্থানান্তর শুরু করতে বাধ্য হচ্ছেন। জুনের ১১ তারিখ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ চামড়া কারখানা হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে।
দেশের সব অঞ্চলে উন্নয়নের ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। রাজধানীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ যেমন জরুরি, তেমনি বেসরকারি খাতের সহযোগিতাও জরুরি। সরকার ঢাকার বাইরে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও আইটি পার্ক স্থাপন করেছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঢাকার বাইরে যেতে উৎসাহী করতে হলে কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
যে মানুষ ঢাকায় এসে রিকশা চালান, তাঁর এলাকায় একটি শিল্পকারখানা থাকলে হয়তো তিনি এখানে আসতেন না। যে সবজিচাষি উৎপাদনে বীতস্পৃহ হয়ে ঢাকায় এসেছেন, তিনি হয়তো ন্যায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা থাকলে ঢাকায় আসতেন না। ন্যায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতিবন্ধক হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটগুলো, যাদের পকেটে ঢোকে কৃষকের শ্রম আর ঋণের টাকায় উৎপাদিত পণ্যের সিংহভাগ লভ্যাংশ। ন্যায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারলে কৃষি গ্রামীণ উৎপাদন আরও নিরুৎসাহিত হবে। একসময় এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য ঢাকা ও এর আশপাশে নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকারখানা স্থাপন বন্ধ করতে সরকার ও সিটি করপোরেশনকে কঠোর হতে হবে। যেসব এলাকায় কর্মসংস্থানের সংকট রয়েছে, সেসব এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। সর্বোপরি আমাদের ঢাকাকেন্দ্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।