বাংলার দর্পন ডটকম :
‘চিকুনগুনিয়া জ্বরে প্রথমে আক্রান্ত হলো আমার স্ত্রী। এরপর আমার মা। আমার ১১ মাসের মেয়ে যখন আক্রান্ত হলো, সে যন্ত্রণা সইবার নয়। শেষে আক্রান্ত হলাম আমি। সব মিলিয়ে গত একটা মাস ছিল বিভীষিকাময়।’
মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসিন্দা কনক বড়ুয়া গতকাল মঙ্গলবার কথাগুলো বলছিলেন। তাঁর অভিযোগ, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হলেও তিনি তাঁর এলাকায় মশা নিধনে কোনো কার্যক্রম দেখেননি। আর মশার ওষুধ ছিটানো হলেও আদৌ কোনো মশা মরেছে কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
ঢাকার ২৮৬ জন নাগরিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আছে অভিযোগ করেছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন সক্রিয় নয়। জবাবে সিটি করপোরেশন বলেছে, তারা ওষুধ ছিটাচ্ছে। তবে জনসচেতনতা ছাড়া মশা দমন করা কঠিন।
ঢাকায় এখন এক আতঙ্কের নাম মশা আর চিকুনগুনিয়া। এই রোগে কেউ মারা না গেলেও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যে ব্যথা হয়, সেই যন্ত্রণা ভয়াবহ। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয় রোগের বাহক এডিস মশা। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসে একাধিকজন আক্রান্ত হন। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রোগী ছাড়া বড় বিস্তার ছিল না। তবে এ বছর ঢাকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।
ঢাকার কোন কোন এলাকায় মশা বেশি এবং চিকুনগুনিয়ায় লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে, তা জানতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন করা হলে নাগরিকেরা জানান, ঢাকা দক্ষিণের আজিমপুর, হাজারীবাগ, বংশাল, চানখাঁরপুল, হোসেনি দালান, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, দোলাইরপাড়, দয়াগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, খিলগাঁও, কমলাপুর, মুগদাপাড়া, লালবাগ, শাহবাগ এলাকায় মশার ভয়াবহ উৎপাত।
উত্তরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, বনশ্রী, তেজগাঁও, বনানী, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়েরবাজার, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টর, মিরপুর, পল্লবী, মণিপুরিপাড়া, মহাখালী এবং কড়াইলে মশার উৎপাত বেশি।
মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন আপনার এলাকায় কী পদক্ষেপ নিয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকার ২৮৬ জন নাগরিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানিয়েছেন, তাঁদের এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়লেও বিষয়টি সিটি করপোরেশন আমলে নিয়েছে বলে মনে হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণের জিগাতলা এলাকার বাসিন্দা আনাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি গাবতলা মসজিদের বিপরীতে থাকি। এখানে ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া। মশার যন্ত্রণা এত বেশি যে দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে থাকতে হয়।’
হাজারীবাগের বাসিন্দা তাহমিনা তৃষা বলেন, ‘এখানে কবে মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে, কেউ বলতে পারবে না।’ মোহাম্মদপুরের বছিলার বাসিন্দা শম্পা রেজা বলেন, ‘বছিলায় মনে হয় মশার কার্পেট বিছানো।’
মোহাম্মদপুরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের মশা মারার জন্য পর্যাপ্ত ফগার মেশিন নেই। আমাদের এলাকা অনেক বড়। কিন্তু মেশিন মাত্র পাঁচটা। আমরা পর্যাপ্ত যন্ত্র চেয়েছি।’
মিরপুরের রূপনগরের বাসিন্দা তুসিন আহমেদ অভিযোগ করেন, গত এক বছরে তিনি এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি। জিয়া চৌধুরী, বিল্লাল হোসেনসহ আরও অনেকেরই অভিযোগ, মিরপুর ১ এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা নেই।
জানতে চাইলে মিরপুর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন বলেন, ‘আমি কিছুদিন দেশে ছিলাম না। ওমরাহ্ করে এলাম। এখন বিষয়টা দেখব।’
বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা কানিজ বলেন, এখানে বেলা ১১টা পর্যন্ত মশার উৎপাত থাকে। দিনের বেলায়ও মশারিতে থাকতে হয়।
ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়াহিদুল হাসান বলেন, ‘১৫ দিন ধরে আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছি।’
তাহলে কি ওষুধে মশা মরছে না? এই প্রশ্নের জবাবে মশক নিধনে নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সুপারভাইজার বলেন, ‘ওষুধে মশা মরে কি মরে না, সেটা আমাদের জিজ্ঞাসা করেন কেন? আমাদের যে ওষুধ দেয়, আমরা সেই ওষুধ ছিটাই। মশা মরে না কেন, সেটা আমরা জানি না।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শেখ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘তিনটি সংস্থার পরীক্ষার পরেই মশার ওষুধ ছিটানো হয়। আর আমরা মূলত ড্রেনে স্প্রে করে মশার শূককীট মারি। এটাই কার্যকর পদ্ধতি। উড়ন্ত মশা মারতে হলে যেভাবে ওষুধ ছিটাতে হবে, সেটা নগরবাসীর জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা ২১ মে থেকে ২৮ মে এক সপ্তাহ ক্র্যাশ কর্মসূচি করেছি। ১৮ জুন থেকে পরবর্তী এক মাস প্রতিটি ওয়ার্ডে দুজন করে কর্মী অতিরিক্ত কাজ করবে।’
তবে ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম এম সালেহ ভূঁইয়া মনে করেন, মশা মেরে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এমন ভাবলে বোকামি। চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি জরুরি জনসচেতনতা। বাসাবাড়িতে টবে যেন পানি না জমে; ফ্রিজের, এসির পানি যেন পরিষ্কার করা হয়, এগুলো দেখতে হবে। জনসচেতনতা ছাড়া মশা দমন করা কঠিন।