বন বিনাশ হচ্ছে – পরিবেশ হুমকির মুখে : অধিকার হারাচ্ছে বনজীবী মানুষ

 

বাংলার দর্পন ডটকম :

আজ ১৩ বছর হয়ে গেল উৎপল নকরেকের (৩২) জীবন কাটছে হুইলচেয়ারে। টগবগে তরুণটির শরীরের নিচের অংশ এখন অবশ। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি গুলিবিদ্ধ হন টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবনের গ্রাম বেদুরিয়ার এই যুবক। বন বিভাগ তখন ইকোপার্কের নামে পর্যটনকেন্দ্র করতে কয়েক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। রুখে দাঁড়াল বনবাসী গারো-কোচরা। ওই দিন ইকোপার্ক-বিরোধী মিছিলে শামিল হয়েছিলেন উৎপল। তিনি বললেন, ‘বনরক্ষী আর পুলিশ গুলি চালাইল। এরপর থাইক্যা এ অবস্থা।’

ওই দিনের ঘটনায় উৎপল প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু বনরক্ষীদের গুলিতেই প্রাণ চলে যায় পীরেন স্নালের। উত্তাল হয় লালমাটির শালবন, সেই সঙ্গে সারা দেশ। প্রতিবাদে ইকোপার্ক পরিকল্পনা বাদ দেয় বন বিভাগ।

এভাবে প্রকৃতি রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হতে হচ্ছে বননির্ভর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে। এমন অবস্থাতেই ৫ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। যার এ বছরের স্লোগান, ‘আমি প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার’। প্রকৃতির বড় অংশ প্রাকৃতিক বনের বিনাশ কিন্তু থেমে নেই। বনবাসী, বিভিন্ন অধিকার সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধু মধুপুরে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেট—যেখানে বনবাসী মানুষ আছে, তারা দিন দিন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বন থেকে। সরকারি, আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার কথিত উন্নয়ন উদ্যোগ, সামাজিক বনায়ন, জবরদখল বনকে ক্ষীণকায় করছে।

বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, মধুপুর শালবনের টাঙ্গাইল অংশের আয়তন ৪৬ হাজার একর। এর মধ্যে ২৫ হাজার একর চলে গেছে অবৈধ দখলে, ৭ হাজার ৮০০ একর রাবার চাষে, এক হাজার একর বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য। বন বিভাগের হাতে আছে মাত্র নয় হাজার একর জায়গা। মধুপুরে বন বিনাশের বড় কারণ বলে এ বনের মানুষ দায়ী করে আশির দশকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে সামাজিক বনায়ন প্রকল্পকে। এ সময় প্রাকৃতিক বন কেটে লাগানো হয় ইউক্যালিপটাস, আকাশিয়াগাছ। এ প্রকল্পে উপকারভোগী করা হয় বহিরাগত বাঙালিদের। বনের প্রবীণ অধিবাসী জেরোম হাগিদগ বলছিলেন, ‘বন বিভাগ শালবন কেটে ইউক্যালিপটাস, আকাশিয়াগাছ লাগাইল। সামাজিক বনায়নের নামে শুরু হইল লুটপাট। শালবনও গেল, এই সামাজিক বনায়নও কাজে লাগল না।’

 

নির্দিষ্ট সময়ে এসব লাগানো গাছ কাটার কথা থাকলেও ব্যাপক চুরি, লুটপাট শুরু হয়। কিন্তু এ বনে শাল আর ফিরে আসেনি।

গারো জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা এ বনের আদি সন্তান। এই বিপর্যস্ত বনকে তাঁদের দেখা বনের সঙ্গে আর মেলাতেই পারেন না এখানকার বয়স্ক ব্যক্তিরা। স্থানীয় নেতা অজয় মৃ বলেন, ‘আমাদের খাদ্য, জ্বালানির উৎস ছিল এই বন। সেসব হারানোর পাশাপাশি এ বনের পশুপাখিও নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাঘ, ময়ূর শূকর—কত প্রাণী দেখেছি। এখন এসব স্মৃতি।’

বন ঘিরে অতীতের মধুর স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে। বন বিভাগ, এসব জবরদখলকারীর সঙ্গে নানা সময় সংঘাতে নিহত হয়েছেন গিদিতা রেমা, বিহেন নকরেক, চলেশ রিছিলের মতো নারী-পুরুষ।

মধুপুরবাসীর অভিজ্ঞতায় নতুন সংযোজন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বনের নয় হাজার একরের বেশি এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণা। সেখানে ছয় হাজার গারোর বসবাস। তারা এখন উচ্ছেদের আতঙ্কে।

সামাজিক বনায়ন সফল হয়নি, এ কথা মানেন না টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা। শালবনে আকাশিয়ার বা ইউক্যালিপটাসের বিস্তারকে বাংলাদেশের বাস্তবতার অংশ বলে মনে করেন তিনি। বনে গারোদের অধিকার খর্ব করার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য হলো, ‘গারোরা বনের উন্নয়ন চায় না। এ বন গারোদের নয়। এটা সরকারের। এর উন্নয়নে গারোরা শরিক হলে এতে তাদেরই লাভ হবে।’

পাহাড়ে খড়্গ বনবাসীর জীবনে

লালমাটির মধুপুরের মতো বিপর্যয় দেখেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বাইশারি গ্রামটি। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার এ গ্রামে ১৯৮০-এর দশকে শুরু হয় রাবার চাষ। একসময়ের ঘন অরণ্য উধাও। এ গ্রামে বাস করে পার্বত্য এলাকার সংখ্যায় খুবই নগণ্য জাতিগোষ্ঠী চাক, সঙ্গে মারমারাও আছেন। তাঁদের জীবনে এই রাবার চাষ বড় বিপর্যয় বয়ে এনেছে। গ্রামের ধুন ছা অং বলছিলেন, ‘আমাদের জুমের জমি আর নেই। পুরোটাই রাবার কোম্পানি দখল করে নিয়েছে।’

পাহাড়ে প্রথাগত চাষপদ্ধতি জুম। হেডম্যান হিসেবে পরিচিত কোনো একটি মৌজার প্রধান পাহাড়িদের বন্দোবস্ত দেন জুম চাষ করার জন্য। পার্বত্য এলাকায় কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে হলে হেডম্যানের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে বাইশারির হেডম্যান মং ছা নু চাক বলেন, ‘আমার কোনো মতই নেওয়া হয়নি।’

কর্ণফুলী কাগজ কলের জন্য নরম কাঠের বন্দোবস্ত করতে বন বিভাগের তিনটি বিভাগ কাজ করে পাহাড়ে। তিনটি পাল্পউড বিভাগের অধীনে ২ লাখ ৬৪ হাজার বনাঞ্চল চলে গেছে এ বনাঞ্চল করতে। রাবারের পাশাপাশি এই পাল্পউড বনাঞ্চল বনবাসীর জীবনে এনেছে এক খড়্গ।

চাকমা সার্কেল প্রধান দেবাশীষ রায় দীঘ সময় ধরে বন ও বননির্ভর মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘বনে থাকা মানুষের বনের ওপর যে প্রথাগত অধিকার আছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর স্বীকৃতি নেই। কোনো উন্নয়নকাজে বনবাসীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় না। আর এর ফলেই বন এবং বননির্ভর মানুষের দুর্গতি।’

 

এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার মেঘাটিলা খাসি পুঞ্জির কাছে থেকে রিমন মিয়া (৩২) নামের এক বাঙালি শ্রমিকের লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় বাঙালিরা অভিযোগ তোলে, স্থানীয় খাসি ও গারোরা তাঁকে হত্যা করেছে। ‘ঐক্যবদ্ধ এলাকাবাসীর’ ব্যানারে সমাবেশ হয়, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ঘটনার পর বালাইমা, আমলি, নিউরাঙ্গিগি, লন্ডন পুঞ্জির খাসিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মারাত্মক ভীতি। মেঘাটিলা পুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) মনিকা খংলা বলেন, ‘এ গ্রামের পুরুষেরা রাতে পুঞ্জিতে থাকতে পারেন না। এমন অবস্থা এখনো চলছে।’

তবে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার শাহ জালাল  বলেন, ‘খাসিদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’

কুলাউড়ার আসলান ও কাইলিন পুঞ্জিতে শত বছরের গাছ কেটে ফেলা এবং উচ্ছেদের বিরুদ্ধে এখন আন্দোলন করছেন খাসিরা। বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের সভাপতি পিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, ‘বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা বনে গাছ নেই। বড় গাছ বলতে যা, তা আছে খাসিদের পান পুঞ্জিতে। তাই এ বন সাবাড় করতে বন বিভাগ এবং তাদের সহযোগী বনদস্যুদের যোগসাজশে খাসিদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে।’ পিডিসন বলেন, সিলেট অঞ্চলে ৯২টি খাসিপুঞ্জি আছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩টি পুঞ্জির মানুষ এখন উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলার ভয়ে আতঙ্কিত।

প্রকৃতিবিদেরা বলছেন, বননির্ভর মানুষের ওপর এসব হামলা-মামলা বড় অপরাধের একটি অংশ মাত্র। এসব ঘটনার নেপথ্যে আছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা। প্রায় চার দশক ধরে সমতল ও পাহাড়ের বন, বননির্ভর মানুষের অধিকার নিয়ে গবেষণা করছেন ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতি ও অরণ্যনির্ভর মানুষের ওপর অপরাধ চলছে। এতে বন বিভাগের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান জড়িত। তাদের ভ্রান্ত নীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা যুক্ত হয়ে এ অপরাধ চলছে।’

বননির্ভর মানুষকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না করা, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার যে অভিযোগ ফিলিপ গাইন ও দেবাশীষ রায় করলেন, এর সঙ্গে একমত নয় বন অধিদপ্তর। প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষয়িত বনভূমিতেই সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করার নীতি আমাদের আছে। এর ব্যত্যয় হয়নি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *