ফেনী :
ফেনী পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সুমন যেন সত্যিকারের ‘দুর্নীতির বরপুত্র’। টানা ২৬ বছর একই স্থানে কর্মরত থেকে সম্পদের পাহাড় গড়লেও রয়েছেন অধরা। এমনকি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের অন্যতম দোসর হলেও জুলাই পরিবর্তনে তার অবস্থার হেরফের হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ শাসনামলে আনোয়ার হোসেন সুমন ছিলেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ঘনিষ্ঠজন। সুমন নিজেকে এমপি হাজারীর ভাগ্নে হিসেবে পরিচয় দিতেন। আর এ সুবাদেই তিনি ছিলেন মহা ক্ষমতাধর। ফেনী পৌরসভায় লুটপাটে জড়িত কয়েক পান্ডবের একজন ছিলেন এই সুমন।
বিভিন্ন সময় তাকে বদলির উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি কখনও কার্যকর হয়নি। তার দাপটের ফিরিস্তি দিয়ে পৌরসভার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দাবি করেছেন, সর্বোচ্চ ব্যক্তি যেই হোক সুমনের কথাই শেষ কথা। কর্মকর্তারা বললেও অনেক কাজ হয় না।
কিন্তু আনোয়ার হোসেন সুমন, বললে হয়ে যায় এবং তা ত্বরিৎগতিতে। তার দুর্নীতির খাতও রয়েছে বহুমুখী। মাস্টার রোলে নিয়োগ অবৈধ হলেও উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সুমন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরাফত উল্যা চৌধুরী ৫০ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও টেন্ডার-কোটেশন ছাড়াই আনোয়ার হোসেন সুমন ও শরাফত উল্যা চৌধুরী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শতকোটি টাকার কেনাকাটা দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। উৎকোচের বিনিময়ে সম্প্রসারিত ভবনের পৌর কর না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নতুন হোল্ডিং, মিউটেশন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, ভবনের নকশা অনুমোদন, যৌথ
জরিপ, ট্রেড লাইসেন্স দিতে ঘুষ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে পরিণত করেছেন। সুমনের অবৈধ আয়ের আরও খাতের মধ্যে আছে হাট-বাজার, ইজারার কোটি কোটি টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না দেওয়া, পৌরসভার ভূমি লিজ-দোকান বরাদ্দ ও মিউটেশনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া। রিকশা, সিএনজি পৌর টাউন সার্ভিস এসব গাড়ির লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে দৈনিক ৫০ ও মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে নেন। আবার অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করারও অভিযোগ রয়েছে।
আনোয়ার হোসেন সুমন সিন্ডিকেটের লোপাটের অন্য ক্ষেত্রগুলো হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন দেখিয়ে বছরে অন্তত কোটি টাকা আত্মসাৎ। পাশাপাশি ‘সুইপার বিল’ নাম দিয়ে মাসে দুই বা ততোধিকবার প্রায় লাখ টাকা করে ১০ বছর ধরে তুলেছে চক্রটি। অর্থাৎ এ খাতে ১৫-২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাল নথিতে নামে-বেনামে কোটি টাকা লোপাট করেছেন আনোয়ার হোসেন সুমন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকৌশলী বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার বলেন, ফেনী পৌরসভার সব উন্নয়ন কাজ শেষে পৌর পরিষদে অনুমোদন করা হতো। এ কৌশলকে পুঁজি করে উপসহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সুমন সব কাজে ৫০-৮০% অতিরিক্ত টাকা ধরে বিল প্রস্তুত করতেন। ঠিকাদারদের কাছ থেকে এ টাকা সুমন আদায় করে নিতের।
আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আনোয়ার হোসেন সুমন। ফেনী সদর ছনুয়া ইউনিয়নের নিজ এলাকায় তার নামে বেনামে বহু জায়গা জমিন রয়েছে। এছাড়া শহরের পূর্ব উকিল পাড়ায় ১০ কোটি টাকার ৭ তলা আনোয়ার ম্যানশন নামে আলিশান বাড়ি, ফেনী মিজান রোডে আলিয়া মাদ্রাসার পূর্বপাশে, ফজল মাস্টার ল্যান্ড রোডে অবস্থিত তার স্ত্রীর নামে রয়েছে দুটি আলিশান ফ্ল্যাট এক একটি ফ্ল্যাট ৩০০০ স্কয়ার বর্গফুটের, এবং আনোয়ার ম্যানশনে একটি অফিস রয়েছে যে অফিসটিতে দুইজন ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত আছেন।
ফেনী পৌরসভায় নকশা পাস করাতে আসা গ্রাহকদের তার অফিসের মাধ্যমে কাজ করাতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করলে সুমনের অপকর্মের আরো ভয়াবহ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
এ ব্যপারে মন্তব্য জানতে মুঠোফোনে আনোয়ার হোসেন সুমনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে পেরে বলেন, ‘আপনাদের সাথে কি আর কথা বলবো আপনারা তো আমাদেরকে দুদকে ঢুকাই দিছেন।’ পরে কথা বলবো বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।