সোনাগাজী(ফেনী):
২০০৩ সালের ১৩ মে রাত অনুমান ২টা। স্বামী ও ২ সন্তান নিয়ে নিজ বসত ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন ৫ মাসের অন্তসত্বা কৃষ্ণা বালা দাস। হঠাৎ ঘরের দরজায় ঠুকঠাক শব্দ। দরজা খোলার জন্য সজোরে করছে আঘাত।
প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে তারা। বাধ্য হয়ে দরজার পাটাতন খুলে দেখি মুর্তমান আতংক হয়ে দাড়িয়ে আছে করে স্থানীয় চিহ্নিত বিএনপি দলীয় ক্যাডাররা। ঘরের ভিতরে ঢুকে প্রথমে এতক্ষন কেন দরজা খুলিসনি বলে আঘাত করতে থাকে আমার অসুস্থ্য স্বামী নেপাল চন্দ দাসকে।
পিতাকে পিটুনি থেকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন আমার কিশোরী মেয়ে লাভলী দাস (ছদ্ম নাম)। মেয়ের বাঁধা পেয়ে তারা আমার স্বামীকে এনে লোহার রড় দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। তাদের আঘাতে আমার স্বামী ঘাঁড়ে মারাত্মক জখম পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ওই সময় ঘরের ভিতর থেকে বাঁচানোর জন্য আমরা চিৎকার শুরু করলে তারা এবার আমার কিশোরী মেয়ের উপর হামলে পড়েন।
আমার মেয়ের ইজ্জত ভিক্ষা চেয়ে তাদের পায়ে পড়লেও গলেনি তাদের পাষান মন। এক পর্যায়ে মেয়ের মুখ চেপে ধরে তারা পাশের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্ধায় নিয়ে যায়।
প্রানের মায়া ত্যাগ করে মেয়েকে বাচাঁতে তাদের পিছনে পিছনে সেখানে যাই। তারপর আমাকে বেঁধে ফেলে আমার সামনে তারা মেয়ের ইজ্জত কেড়ে নেয়। এভাবেই প্রতিবেদকের কাছে নির্যাতনের বর্ণণা দিচ্ছিলেন গনধর্ষনের শিকার কিশোরীর মা কৃষ্ণা বালা দাস।
তিনি কাতর কন্ঠে বলেন, ঘটনার পর ধর্ষকরা মুখ না খুলতে হুমকি দিয়ে বলেন- কাউকে জানালে স্বপরিবারে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে। সকালে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি আমাদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন।
তিনমাসপরে পুলিশ এসে আমাদের থানায় নিয়ে যায়। আমি চার জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করি। পাশবিক নির্যাতনে অসুস্থ্য মেয়ে ও ধর্ষকদের পিটুনীতে গুরতর জখম স্বামীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করি। এদিকে মামলার খবর পেয়ে ধর্ষকরা আমার বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেন।
চিকিৎসারত অবস্থায় ঘটনার ১০ দিন পর ফেনীর একটি বাসায় মারা যায় আমার স্বামী। স্বামীকে দাহ করতে গ্রামের বাড়িতেও নিতে পারিনি। হামলা ও গনধর্ষনের ঘটনায় আমি যাদের চিনতে পেরেছিলাম তারা হলেন নবাবপুর ইউনিয়নের রসুল আহম্মদের ছেলে মোহাম্মদ ফারুক ,ফকির আহমদের ছেলে আবুল কাশেম, আবদুর রশিদের ছেলে মো. লাতু ও আবুল কালামের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
মামলাই যেন কাল হল কিশোরীর পরিবারের।
সামাজিক প্রথায় লোকলজ্জা ও প্রতিনিয়ত হুমকি, ধমকি এবং আতংকের মধ্যে নিজের বসতবাড়ি ছেড়ে স্বপরিবারে চলে যান কিশোরীর নানার বাড়ি রাঙ্গামাটি। সেই যে বাড়ি ছাড়া হয়েছে ১৯ বছরেও বাড়িতে ফেরা হয়নি তাদের।
দীর্ঘ সাড়ে ১৮ বছর পর ফেনীতে ফিরে এলেও আর ফিরতে পারেননি স্বামীর ভিটিতে। উপজেলা সদরের একটি বাড়ীতে এক হাজার চারশত টাকায় টিনসেট ২টি রুম নিয়ে ভাড়া থাকেন তারা।
প্রশাসনের সহযোগিতায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন তবে প্রভাবশালীদের হুমকিতে প্রধান অভিযুক্ত ফারুকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারেনি। আইনজীবি নিয়োগ দিতে পারেননি টাকার অভাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (এপিপি) ফরিদ আহমদ হাজারী মামলাটি পরিচালনা করেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওসমান হায়দার গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্ষণ মামলার ১৯ বছর পর ৩ জনকে মৃত্যুদন্ড- দিয়েছে । একইসাথে প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। মৃত্যুদন্ড- প্রাপ্তরা হলেন আবুল কাশেম, মো. লাতু ও জাহাঙ্গীর আলম। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় মোহাম্মদ ফারুককে বিচারক এ মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। মামলার রায়ের খবর জানতেন না কিশোরীর পরিবার।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এখনো বাড়ী ফিরতে নারাজ কিশোরীর পরিবার । কিশোরীর ভাই ( পলাশ চন্দ্র দাস ) বলেন, আবার যদি কখনো বিএনপি সরকার আসে তাহলে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরা আমাদের মেরে ফেলবে। কারন দন্ডপ্রাপ্তরা এখনো আটক হয়নি। এলাকায় বসবাস করলেও পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক।
ছবিতে : নেপাল দাসের ভিটি । এই ভিটিতে ধর্ষিত হয়েছিল নেপালের মেয়ে ।