সৈয়দ মনির আহমদ :
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সবচেয়ে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। তৃণমূল পর্যায়ে সুষম উন্নয়ন আর গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক সেবাটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউপি নির্বাচন সবসময় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা থাকে। এ ক্ষেত্রে ভোটাররা সাধারণত বিবেচনায় নেন প্রার্থীকে, দলকে নয়। এ বিবেচনায় জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর সম্পর্ক, জনসেবার ঐতিহ্য, পারিবারিক সম্পর্ক প্রভৃতি। দলীয় পরিচয়ও ক্ষেত্র বিশেষে বিবেচনায় থাকে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ভিন্ন দল-মতের হলেও সরকারের উন্নয়ন কাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেন। কয়েক বছর আগ পর্যন্ত ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবেই চলছিল। হঠাৎ আইন পাল্টে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন এভাবে চলল। সময় এসেছে এটা মূল্যায়নের।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় নয়টি ইউনিয়ন। ইতিমধ্যে সকল ইউনিয়ন পরিষদ মেয়াদ উত্তীর্ণ। নভেম্বরের শুরুতে ঘোষনা হতে পারে তফসিল । বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ও বিএনপিসহ প্রায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের ঘোষনার কারনে এবার চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থীর বদলে উম্মুক্ত এবং প্রতিদ্বন্ধিতামুলক নির্বাচন দেখতে চান স্থানীয় ভোটার এবং আ’লীগের প্রাণ তৃনমুল নেতাকর্মীরা।
সোনাগাজী উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিং এর আহবায়ক ডাঃ গোলাম মাওলা বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। সে সুযোগ কাজেও লাগানো হয়। এক সময়ে আমাদের দেশে ইউপি নির্বাচন মানুষের কাছে একটা বড় উৎসবের উপলক্ষ ছিল। একটা নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে আরেকটা নির্বাচনের জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত।
উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হাজী আবু সুফিয়ান বলেন, আগের দিনে দেখেছি কিভাবে মানুষ তার এলাকার বা সমর্থিত প্রার্থীর জন্য স্বেচ্ছায় কাজ করতেন। ইউপি নির্বাচনে তখন দলীয় প্রভাব ছিল খুবই কম, এলাকা বা গ্রাম ভিত্তিক প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। এলাকার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখেছি, নির্বাচনে না থাকলেও ভোটে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল এখন উল্টো।
সোনাগাজী উপজেলা আ’লীগের সহ সভাপতি অধ্যাপক নাফিজ উদ্দিন বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হবার ঘোর বিরোধী, যদিও সরকার যখন আইন করেছে সেটা প্রয়োজন বিবেচনাতেই করেছে। কিন্তু একটি ইউনিয়নে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই একটি দলের একই পর্যায়ের একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকেন, এক্ষেত্রে একজনকে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করে সমযোগ্যতার অন্যদের জোরকরে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়, একই সাথে এটাও বিবেচ্য বিষয় যে, তৃণমূলের যেসকল নেতারা বড় বড় রাজনৈতিক দলের প্রতীক ব্যবহার করেন, সত্যিকার অর্থেই কি তারা সেই প্রতীকের ভার বহন করার যোগ্যতা রাখেন ? দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ফলে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীরা যেমন অবহেলিত হচ্ছেন, তেমনি সুবিধাবাদীদের কারণে দলীয় অসন্তোষ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
সোনাগাজী উপজেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (সাবেক) সলিম উল্যাহ জানান, যাদের পরিবার আজীবন নৌকার বিরুদ্ধে ছিল, যারা কখনো নৌকায় ভোট দেয়নি , অপরাজনীতির কারনে ঘোর নৌকা বিরোধিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে নৌকা। যেহেতু অন্যদল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেনা, সেহেতু আ’লীগের নেতাদের মধ্যে উম্মুক্ত ভোট হলে জনগনের পছন্দের প্রার্র্থী জিতবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে ইউনিয়নের কাঙ্খিত উন্নয়ন হবে।
উপজেলা আ’লীগের প্রচার সম্পাদক (সাবেক) সৈয়দ দীন মোহাম্মদ বলেন, ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের কারনে অধিকাংশ চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। ওই চেয়ারম্যানগণ কোনভাবেই প্রান্তিক জনগনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবেনা । দলীয় প্রতিক ব্যবহার না করে সত্যিকারের উৎসবমুখর পরিবেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা এখন সময়ের দাবি। এতে আ’লীগের তৃনমূলে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
উপজেলা আ’লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শামসুল আরেফিন বলেন, নেতা নির্ভর নেতারাই দলীয় প্রতিক পাচ্ছেন। যারা দলের কর্মকান্ডে কখনো ছিলেন না , দলের তৃনমুলে যাদের সম্পর্ক নেই , এলাকার ভোটারদের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই তারাই কৌশলে জেলা নেতাদের ম্যানেজ করে নৌকা বাগিয়ে নিচ্ছেন। শুধুমাত্র প্রতিকের কারনে একজন জনবিচ্ছিন্ন ও স্থানীয় বিষয়ে অনবিজ্ঞ লোক চেয়ারম্যান হয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন , প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে পারবেনা।
তিনি আরো বলেন, গত নির্বাচনে দলীয় প্রতিকে বিজয়ী অনেক চেয়ারম্যানের কারনে দলের ও সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হয়েছে । কয়েকজন স্বীয় কর্মের কারনে নিজেই কারাবন্দি ছিলেন। সেবা বঞ্চিত হয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী । আসন্ন ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার ব্যতিরেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আ’লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা’র কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।