স্বাধীনতার ৫০ বছরেও অরক্ষিত দাউদকান্দির রায়পুর বধ্যভূমি

দাউদকান্দি(কুমিল্লা)প্রতিনিধি
আজ ২৩ মে, ১৯৭১ সালের এই দিনে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর গ্রামে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আজও অরক্ষিত রয়েগেছে রায়পুর বধ্যভূমি। সংরক্ষণের অভাবে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। গত কয়েক বছর ১৪ডিসেম্বর মোমবাতি প্রজ্জলনের মাধ্যমে স্বরন করা হলেও এরপর খোঁজ রাখে না কেউ। ফলে এলাকার লোকজনের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা দাউদকান্দির স্বাধীনতাকামী ও হিন্দু ধর্মের লোকজনদের ধরে নিয়ে রায়পুর কাঠের পুলের নিকট হত্যা করে পাশের ডোবায় ফেলে রাখে। তারপর থেকেই ওই স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দাউদকান্দি উপজেলার জিংলাতলি ইউনিয়নের রায়পুর বধ্যভূমি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বানিয়াপাড়া দরবার শরিফের পুর্বপাশে রায়পুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থান হতে একটি কাঁচা রাস্তা উত্তরপশ্চিম দিকে চলে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে কিছু দূর অগ্রসর হলেই একটি খালের উপর রয়েছে রায়পুর সেতু। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কাঠের পুল ছিল এটি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিবাহিনীর সহযোগী সন্দেহে নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে কাঠের পুলের উপর এনে গুলি করে হত্যার পর লাশ খালের পানিতে ফেলে দিত। আবার অনেককে হত্যার পর পুলের দক্ষিণ পাশে গর্ত করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে বলেও জানান এলাকার ষাটর্ধো এরশাদ মিয়া ও সামসুল হক। সেদিন ১৯৭১ সালের ২৩শে মে রবিবার সংঘটিত গণহত্যায় রায়পুর গ্রামের যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন, রায়পুর গ্রামের রাম মানিক্য দেবনাথের ছেলে শহিদ ডা. পা-ব দেবনাথ, বলরাম সরকারের ছেলে শহিদ শীতল চন্দ্র সরকার, কেবলা সাহার ছেলে শহিদ পা-ব সাহা, পা-ব সাহার স্ত্রী বিদেশিনি শাহা, রাজা রাম সরকারের ছেলে শহিদ ফেলান সরকার, জয় চন্দ্র সরকারের ছেলে শহিদ শরৎ চন্দ্র সরকার, লাল মোহন বণিকের ছেলে শহিদ সুধীর বণিক, নরেন্দ্র দেবনাথের স্ত্রী শহিদ কামিনী সুন্দরী দেবনাথ, রমেশ চন্দ্র সরকারের ছেলে শহিদ উমেশ সরকার, রাম দয়াল দেবনাথের ছেলে শহিদ অনাথ দেবনাথ এছাড়া আদমপুর গ্রামের শহিদ অনুকূল সরকার এবং বরুড়া উপজেলার রামমোহন গ্রামের শহিদ নুরু মিয়া।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও রায়পুর গণহত্যার স্থানে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। গণহত্যার স্থানে কাঠের পুলের জায়গায় নির্মিত হয়েছে পাকা সেতু। এই সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার লোকজনের যাতায়াত। এলাকাবাসী গণহত্যার স্থানটিকে একসময় বাঁশের বেড়া দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছিলেন, এখন তাও নেই। চার বছর বছর আগে উপজেলা প্রশাসন একটি পিলার সাদৃশ্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও সেটি ধ্বসে পড়ে যায় বলে এলাকাবাসী জানায়। পরে ২০১৮ সালে আরেকটি পিলার সাদৃশ্য স্তম্ভ নির্মাণ করে উপজেলা প্রশাসন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন মিয়াজী বলেন, ২৩শে মে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমেই রায়পুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাসেতের বাড়ি ঘেরাও করে আমাদের খুঁজতে থাকে। কিন্তু আমাদের না পেয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে । কয়েকজন এদেশীয় দোসরকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ৪০/৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য রায়পুর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা হিন্দু পরিবারের ১০-১২ জনকে ধরে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে জোরপূর্বক সেতুর কাছে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশগুলো লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়। গুলির আঘাতে অনেকের মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে মগজ বের হয়ে যায়। তারপর তারা বিভিন্ন বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট শেষে সিরাজ বিটির বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। গণহত্যার স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ২০২১ সালের ২৩ রবিবার এবং ১৯৭১ সালের এই দিনটিও রবিবার ছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বারের মিল পেলেও রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের কথার কোন মিল পাইনি। কারণ শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটি কোন সীমানা পিলার নাকি স্মৃতিস্তম্ভ।

দাউদকান্দি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রায়পুর গ্রামের অমূল্য বণিক আক্ষেপ করে বলেন, ডিসেম্বর মাস আসলেই আমরা শহীদদের কথা মনে করি। শুধু একটি দিনের মধ্যে এদের স্মরণ করা দুঃখজনক। যাদের জন্য আমরা লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন একটি রাষ্ট্র তাদেরকে সব সময় স্মরণে রাখতে হবে। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে বধ্যভূমি সংরক্ষণ অতি জরুরি।

শহিদদের স্মরণে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহিদদের আত্মত্যাগের কথা জানতে পারবে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বাষার খান বলেন, স্বাধীনতার গৌরবময় ৫০ বছর উদযাপন করছি আমরা। এতদিন পরও রায়পুর বধ্যভূমি অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক। শহীদের স্বজন, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের।

কিন্তু সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি আজও! রায়পুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের শহীদ নারী-পুরুষের সঠিক নামফলক এবং নৃশংস এই গণহত্যার ইতিহাসসহ সেখানে যত দ্রুত সম্ভব স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা দরকার। যাতে এই বধ্যভূমির পাশ দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারে, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়, দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি, জানা আছে জগৎময়’ সেই করুণ আত্মত্যাগের ইতিহাস। একইসঙ্গে এখানকার সকল শহীদ পরিবারকে সম্মাননা এবং অসহায় পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন।

উপজেলা চেয়ারম্যন মেজর(অবঃ) মোহাম্মদ আলী সুমন বলেন আমি আজ রবিবার সকালে রায়পুর গণহত্যাকান্ডের এলাকা পরিদর্শন করেছি। আগামী এক বছরের মধ্যে পাক বাহিনীর হাতে নিহতদের নামের তালিকাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত রায়পুর বধ্যভূমিকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *