আল-জাজিরায় ডেভিড বার্গম্যানের ফিকশন

স্বদেশ রায় :
গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কিছু লোক খুব উৎসাহিত ছিল। তারা একে অপরকে গোপন তথ্যটি দিতে দিতে এই ঢাকা শহরের কয়েক হাজার মানুষকে এ তথ্যটি দিয়েছিল, ২ ফেব্রুয়ারি রাত দুইটায় আল-জাজিরায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে একটি বড় রিপোর্ট প্রচার হবে। পুরো রিপোর্টটির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন ডেভিড বার্গম্যান।

কথাটা যখন কানে আসে, তখন ধরেই নি এমন একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। কয়েক বন্ধুবান্ধব বলেন, এত লোকে জানে, তাহলে এটা সত্য কিছু নয়। উড়ো খবর। তাদের হেসে বলি, এটাই বাঙালির স্বভাব। সব থেকে বেশি নিয়মতান্ত্রিক পার্টি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। তাদেরও গোপন খবর অন্তত কয়েক শ লোকে জানত। তাই জামায়াত-বিএনপি সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার লোক যদি এ খবর জানে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে!

সেনাপ্রধানকে যখন জড়াবে, তখন ধরেই নিয়েছিলাম তাঁর ভাই জোসেফের কথা বলবে। কারণ, তিনি যখন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন, তখন একটি অনলাইন পোর্টাল জোসেফকে সন্ত্রাসী বলে নিউজ করেছিল। তার কিছুটা প্রতিক্রিয়াও হয় সরকারি মহল থেকে। ওই সময়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক একটু ক্রোধের সঙ্গে আমাকে বলে, সন্ত্রাসীকে নিয়ে নিউজ করে এমন ফল ভোগ করতে হবে! এটা কোন দেশ! শান্ত মাথায় তাদের বলেছিলাম দেখো, সাংবাদিকতা করতে হলে একটু অতীত ইতিহাস জানতে হয়। আর এই জানার কাজটি করা খুব কঠিনও নয়। আমরা কেউ আকবরের আমলে জন্ম নেয়নি। কিন্তু সকলে আকবরের আমল জানি। অথচ তোমাদের দুর্ভাগ্য হলো, তোমরা সাংবাদিকতা করো, অথচ আশির দশকটা জানো না। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে, অর্থাৎ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে কী ঘটেছিল, তা জানো না। তোমরা সকলে জানো আওরঙ্গ সন্ত্রাসী। সে সেনাবাহিনীর লোকের গায়ে গুলি করেছিল। কিন্তু তোমরা কি জানো, জিয়াউর রহমান নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ভালো ছেলেকে নিয়ে গিয়ে অস্ত্র চালানো শিখিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তখন হলে হলে ছাত্রদের সঙ্গে তার বাহিনীর লোক ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

আশির দশকে যখন শেখ হাসিনা ফিরে আসেন, তার তখনকার দিনগুলো তোমরা এখনকার সাংবাদিকরা ঠিক বুঝতে পারবে না। তখন পথে পথে বিএনপির সশস্ত্র গুণ্ডারা কীভাবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল, তা আজ বোঝা কষ্টকর। তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রাজনীতিতে দারুণভাবে সক্রিয়। তারা সব সময়ে সচেষ্ট ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে।

এরশাদ ক্ষমতায় এসেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সেই সুযোগ সমানভাবে দেয়। সে সময়ে কীভাবে আওয়ামী লীগের এই সাহসী কর্মীরা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করত, তার ইতিহাস তোমাদের জানা দরকার। তাদের বলি, নজীব এখন অসুস্থ, তবে তারপরেও তার কাছে শুনতে পারো, মৃণালের কাছে শুনতে পারো, তারা কীভাবে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করত। জোসেফরা তাদেরই মতো একজন ছিল। এমনি হাজার হাজার কর্মী ছিল শেখ হাসিনার সারা দেশে। চট্টগ্রামে যেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়, সেদিন তো কাছ থেকে দেখেছি। শ্রমিক লীগের ওই নেতা যদি ঝাঁপ দিয়ে নিজের বুকে গুলি না নিত, তাহলে সেদিন ওই পুলিশের গুলিতে শেখ হাসিনার প্রাণ যেত। তাদের আরো বিষয়টি সহজ করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বলি, ২১ আগস্ট যেমন গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর জন্য বড় বড় নেতা মানবঢাল তৈরি করে নিজেদের শরীরে গ্রেনেড নিয়ে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছিল সেদিন। নজীব, রহুল, জোসেফ, হারিস, এরা সকলে সব সময়ই শেখ হাসিনাকে সেদিন তেমনি ঘিরে থাকত। যাতে শত্রুর বুলেটটি তাদের গায়ে লাগে, শেখ হাসিনার গায়ে না লাগে। তাদের এও বলি, এগুলো আরো ভালোভাবে জানতে তোমরা মৃণাল, নজীব ওদের কাছে যাও। জানতে পারবে। এগুলো না জেনে বিএনপি ক্ষমতায় এসে কার নামে সন্ত্রাস বা খুনের মামলা দিল, আর তোমরা তাকে সন্ত্রাসী ধরে নেবে? বিএনপি তো ক্ষমতায় এসে সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফেরি থেকে কাপ-পিরিচ চুরির মামলা দিয়েছিল? সাবের হোসেন চৌধুরী কি কাপ-পিরিচ চোর? ১/১১-এর পরে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ৩টি বিয়ারের ক্যান রাখার অপরাধে মামলা দিয়েছিল। ঢাকা ক্লাবে তোমরা বিয়ার খাও না? তাহলে মওদুদ আহমদ দুই ক্যান বিয়ার খেয়ে জেলে যাওয়ার মতো অপরাধী হয়ে গেলেন?

জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরে দুই বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এবার দেখি আল-জাজিরা টেলিভিশনে বার্গম্যান একই ফিকশন নিয়ে এসেছেন জোসেফদের নিয়ে। বার্গম্যান ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি এত বড় সাংবাদিক যদি হন, তাহলে একটি দেশের সেনাপ্রধান ও প্রাইম মিনিস্টারের ঘটনা নিয়ে নিউজ করতে তিনি বিবিসিতে গেলেন না কেন? তিনি ইসলামী ব্রাদারহুডের অর্থায়নে পরিচালিত আল-জাজিরায় কেন গেলেন? আল-জাজিরার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ডেভিড বার্গমানের কী সম্পর্ক, তা জানা যায় না। তবে বাংলাদেশে ২০০৯-এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে আল-জাজিরা ও ডেভিড বার্গম্যানের একটা মিল সকলেই দেখেছে। আল-জাজিরা দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নিউজ করে গেছে। ডেভিড বার্গম্যানও তার লন্ডনের আইন পেশা ছেড়ে বাংলাদেশে মাত্র কয়েক হাজার টাকার একটি সাংবাদিকতার চাকরি নিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নিউজ করে গেছেন। তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে, তার কথার লাইন বিটুইনে যা বুঝেছি, তাতে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কোনো মিশন নিয়ে এই সাংবাদিকতা করতেন না। কারণ, নিজেই ব্যক্তিগত আলোচনায় বলেছেন, এদের ফাঁসি হয়ে যাবে। আর দু-একটি বিদেশি বিবৃতি ছাড়া এদের পক্ষে কিছু পাওয়া যাবে না। তবে তার আচরণ থেকে বোঝা যেত, তিনি তার কাজের বিনিময়ে কোথাও একটা বড় অস্বচ্ছ অর্থ পাচ্ছেন। যা তার অতীতের সব অবস্থান ভুলিয়ে এই কাজে নামিয়েছে।

বার্গম্যান তার ফিকশনে সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে দুর্নীতিপরায়ণ বানানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি তার ভাইকে দিয়ে বলাতে চেয়েছেন, তারা একটি হোটেল কিনবেন? হোটেল ব্যবসা করবেন বিদেশে। কিন্তু সেনাপ্রধানের বিদেশে কোথাও কোনো হোটেল আছে, তার প্রমাণ তো দিতে পারেননি। অথচ মিয়ানমারের যে সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখল করেছেন, তার পাঁচটি ফাইভ স্টার হোটেল আছে শুধু থাইল্যান্ডে। এ তথ্য তো পৃথিবীর নানান পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ডেভিড বা তার সঙ্গীরা একটি তথ্য ও প্রমাণ ছাড়াই যে রিপোর্ট এগিয়ে নিয়ে গেলেন, সেটা ফিকশন হতে পারে, আর যা-ই হোক রিপোর্ট নয়।

এরপরে ডেভিড ও তার সঙ্গীরা রিপোর্টে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আজিজ আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী পরিবারের ছেলে বলেই সেনাপ্রধান হয়েছেন? আল-জাজিরা কর্তৃপক্ষও খুব সহজে সেটাই প্রচার করল। আল-জাজিরার খুব বেশি দোষ নয়। কারণ, তারা যে কাতারে আছে, ওই কাতারের সেনাপ্রধান হলেন কাতারের বাদশাহর ছোট ভাই। কিন্তু এখানে তো আজিজ আহমেদ শুধু পরিবারের কারণে সেনাপ্রধান হননি। সেনাবাহিনীতে ঢুকে একের পরে এক প্রমোশন পেয়ে, যোগ্যতা প্রমাণ করে তিনি এই পর্যায়ে এসেছেন। ডেভিড বার্গম্যান আইন ব্যবসা ছেড়ে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলাদেশে যে কাগজে তিনি সাংবাদিকতা করতেন, সেখানে তার বেতন কয়েক হাজার টাকা।

তাই অনেকেই অভিযোগ করেছে, তার পেছনে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীরা অর্থ ব্যয় করে। এর অবশ্য কোনো প্রমাণ কারো হাতে নেই। তবে একটা প্রশ্ন সব সময়ই আসে, বাংলাদেশে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে আমেরিকা ও ইউরোপে বাস করছে। তারা সেখানে কিছুই করে না। অথচ রাজার হালে চলে। তাদের জীবনযাপনের এই অর্থ কোত্থেকে আসে? সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা যেমন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর ফাঁসি না দেয়ার জন্য যে পথে অর্থ পেয়েছিলেন, এরাও কি সেই পথে অর্থ পায়? বার্গম্যানের এই ফিকশন তৈরি করতে বুদাপেস্ট, তুরস্ক, প্যারিসসহ নানান জায়গায় যেতে হয়েছে? স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে, কে স্পন্সর করেছে?

তবে বার্গম্যানের এই ফিকশনকে শুধু ফিকশন তৈরির জন্য মনে করলে ভুল হবে। কারণ, এর উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। তিনি একটি দেশের সেনাপ্রধানের চরিত্রকে মিথ্যা দোষ দিয়ে কলঙ্কিত করে, মূলত একটি অপচেষ্টা শুরু করতে চাচ্ছেন। আর সে অপচেষ্টাটিও অতি সোজা। অর্থাৎ তরুণ সেনাসদস্যদের মধ্যে সেনাপ্রধান সম্পর্কে একটি প্রশ্ন তুলে দেয়া। কারণ, তারা জানেন না বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে কী দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই স্থানে আসতে হয়েছে। আজ তরুণ সেনাসদস্যরা যেভাবে নিজের জীবন বাজি রেখে শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা করে, সেদিন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের তরুণ কর্মীরাই সে কাজটি করত।

এবং তারা যে নিয়ম মেনে করত, তার প্রমাণ বার্গম্যানের ফিকশনের ফাঁকেও রয়ে গেছে। জোসেফ ও হারিসকে খুনি বানাতে গিয়ে একপর্যায়ে বলেছে, লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে গুলি করে। এর থেকে বোঝা যায়, সেদিন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বডিগার্ডদের জন্য বৈধভাবেই অস্ত্র রাখার অনুমতি নেয়া হতো। তবে এটা সত্য, ওই দু-একটি পিস্তল বা রিভলবার নয়, সেদিন এই তরুণরা জীবন বাজি রেখেই শেখ হাসিনার জীবনকে রক্ষা করেছে। তাই এখন সব থেকে বড় বিষয় হলো শেখ হাসিনার সংগ্রামী জীবনের সেই দিনগুলো সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। কারণ, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬, তারপরে আবার পাঁচ বছর রাজপথে।

আর আজ ২০২১। অনেক নতুন প্রজন্ম এর মধ্যে জন্ম নিয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সেই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীও এখন আর নেই। বরং আওয়ামী লীগ বলতে বোঝায় ক্ষমতার আশপাশে ঘোরাফেরা করা মানুষকে। আর এ কারণেই বার্গম্যানরা সহজে এই ফিকশন নিয়ে উপস্থিত হতে পারছে।

লেখক: সম্পাদক, সারাক্ষণ; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *