ফেনীতে দালাল ছাড়া মিলছে না পাসপোর্ট, সেবা গ্রহীতাদের চরম ভোগান্তি | বাংলারদর্পণ

জহিরুল হক মিলন, ফেনী
ফেনীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফি বা উৎকোচ ছাড়া মিলছে না পাসপোর্ট। এছাড়া অযথা নানা হয়রানী ছাড়াও পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়।

কোনো প্রতিবাদ করতে গেলেই বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখান পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ রকম শত শত অভিযোগ থাকলেও দেখার কেউ নেই। ফলে প্রতিকার পাচ্ছে না সেবা গ্রহীতারা।

পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, সারাদেশের ন্যায় ফেনীতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে ই-পাসপোর্ট সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। করোনাকালে কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু হয় ই-পাসপোর্ট সেবা।

শুরু থেকে এ পর্যন্ত ই-পাসপোর্টের আবেদন হয়েছে আট হাজার ৪৯৪টি। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৭০১টি ডেলিভারি হয়েছে। প্রায় ১০ মাস ধরে ঝুলে আছে দুই হাজার ৭৯৩টি পাসপোর্ট। অপরদিকে মেশিন-রিডেবল-পাসপোর্ট (এমআরপি) সীমিতভাবে চালু রয়েছে ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালাল ছাড়া ফেনীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা দিতে গেলে অসম্পূর্ণ তথ্য, আবেদন ফরমে কাটা ছেঁড়া, হাতের লেখা অস্পষ্টসহ নানা অযুহাত দেখিয়ে সেবা গ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। সকালে এসে দিনভর ঘুরেও আবেদন জমা না দিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে সরাসরি আবেদনকারীদের।

আর যেসব আবেদন দালালের মাধ্যমে আসে সেখানে গোপন সংকেত বা স্বাক্ষর দেয়া থাকে। সেগুলো কোনো রকমের হয়রানি ছাড়াই জমা নেয়া হয়।

সম্প্রতি ফেনী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে জেলার ছয়টি উপজেলায় অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতা মতো গড়ে উঠেছে প্রায় তিন শতাধিক ট্রাভেল এজেন্সি। তার মধ্যে জেলা শহরের রয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক। যার বেশির ভাগই লাইসেন্সবিহীন।

এতে এজেন্সির লোকজন জড়িয়ে পড়ছে মানব পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে। নিবার্হী ম্যাজিষ্ট্রেট বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ওইসব এজেন্সি সিলগালা করলেও কিছুদিন পর ঠিকানা পরিবর্তন করে ফিরে যায় পুরানো কর্মকাণ্ডে।

ট্রাভেল এজেন্সির মূল কাজ বাস, ট্রেন ও প্লেনের টিকেটের বিক্রি ও হোটেল বুকিং সংক্রান্ত। অভিযোগ রয়েছে মূল কাজ বাদ দিয়ে বেশির ভাগ এজেন্সি ব্যস্ত পাসপোর্ট দালালি নিয়ে। ট্রাভেল এজেন্সি চালুর জন্যে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম থাকলেও দু-চারটি ব্যতীত কোনো প্রতিষ্ঠানেরই লাইসেন্স নেই।

দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ওমরাবাদ গ্রামের পেয়ার আহম্মদ শামীম। তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। যার সিরিয়াল নম্বর ৩৬৩৬৩৫। সরকারি ফি ৩৪৫০টাকা হলেও তিনি এক ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন জমা দেন।

গত ২০ অক্টোবর ২০২০ স্বাভাবিক ডেলিভারি পাওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ প্রায় চার মাস পরও তিনি হাতে পাননি। এর মধ্যে তিনি কয়েক দফা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করলে এক কর্মচারী তাকে বলেন আরও এক হাজার ৫০০ টাকা দিলে দুই দিনের মধ্যে পাসপোর্ট বই হাতে পাওয়া সম্ভব।

তাছাড়া কখন পাসপোর্ট আসবে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। পরে তিনি সহকারী পরিচালকের নিকট গেলে সেও একই সুরে জানান, কখন পাসপোর্ট বই আসে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ফেনীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশের কয়েকটি কম্পিউটার দোকান ও ফেনীর বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসের আনসার, অফিস সহকারীসহ এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে গড়ে উঠেছে দালাল সিন্ডিকেট। এক একটি এজেন্সিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাত-আট জন করে কর্মচারী। এরা নিয়মিত পাসপোর্ট অফিস, থানা ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিএসবি শাখায় যোগাযোগ করে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাভেল এজেন্সির দুজন পরিচালক জানান, প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ছাড়াও পাসপোর্ট অফিসকে তাদের অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ টাকা, পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিএসবি শাখাকে সাতশ ৫০ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করতে হয়।

এভাবে প্রতিটি পাসপোর্টে দুই হাজার ৫০ টাকা করে গ্রাহকদের বাড়তি গুনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক রোহিঙ্গা দালালদের মাধ্যমে টাকা দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৯ সালের ৭ আগস্ট ফেনীর জনশক্তি কর্মসংস্থান অফিসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন রোহিঙ্গা যুবক আব্দুল্লাহ। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের নোয়াপুর গ্রামের মো. জাহানের ছেলে হিসেবে আব্দুর রহমান নামে ফেনী থেকে পাসপোর্ট করেছে ওই রোহিঙ্গা যুবক। তাকে স্থানীয় এক সাংবাদিক পাসপোর্ট তৈরি করে দেয় বলে জানান।

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের ডমুরুয়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুন্নবী রানা জানান, তাঁর পুরাতন পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে ই-পাসপোর্ট করার জন্যে নিজেই অনলাইনে আবেদন করেন। এরপর আবেদনের হার্ডকপি, পাঁচ হাজার ৭৫০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গত ৩ জানুয়ারি ফেনী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আসেন।

দীর্ঘলাইনে অপেক্ষার পর ১০১ নং কক্ষে আবেদন ফরম জমা দিতে গেলে ওই কক্ষের কর্তব্যরত উচ্চমান সহকারী ওমর ফারুক তাঁর কাছে জানতে চান তিনি কী করেন? রানা জানালেন, তিনি ব্যবসা করেন। তখন ওই স্টাফ আগের পাসপোর্টে পেশা সার্ভিস হোল্ডার লেখা এই কথা বলে আবেদন ফরম গ্রহণ না করে ট্রেড লাইসেন্স অথবা প্রত্যায়নপত্র নিয়ে পরদিন তাকে আসতে বলেন।

পরদিন তিনি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে আবারও দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা শেষে ওই কক্ষে আবেদন ফরম জমা দিতে যান। অনেক গড়িমসির পর তাঁর আবেদন জমা নেয়া হয়। এরপর ১০৩ নং কক্ষে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গেলে ওই কক্ষের স্টাফরা জানান, তার আবেদন এখনো জমা হয়নি।

পরে আবার লাইন ধরে ১০১ নং কক্ষে গেলে ওই কক্ষের স্টাফ জানান, অপেক্ষা করেন আপনার আবেদনের কাগজ যাবে। এভাবে দিনভর ঘুরাঘুরির পর ফিঙ্গার প্রিন্ট না দিয়েই তাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। পরদিন ৫ জানুয়ারি আবারও তিনি যথারীতি উপস্থিত হন আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে। বহু গড়িমসির পর শেষমেশ তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার পর যে ডেলিভারি স্লিপ দেয়া হয় সেটিতে তিনি দেখেন, পেশা হিসেবে পাসপোর্টে তার সার্ভিস হোল্ডারই উল্লেখ রয়েছে।

তিনি জানান, পেশা যদি সার্ভিস হোল্ডারই থাকে তাহলে পেশা পরিবর্তনের জন্যে ট্রেড লাইসেন্সের অজুহাত দেখিয়ে অযথা তাকে এক সপ্তাহ ধরে কেনো হয়রানি করা হলো? দালাল ধরে যাননি বলেই তাকে এমন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অফিসের অসাধু চক্রকে শক্তহাতে দমন করে পাসপোর্ট গ্রাহকদের হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তিনি জোর দাবি জানান।

এ রকম অনেকেই পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। প্রাক্তন সহকারী পরিচালক আবুল হোসেন মাঝখানে বছর দুয়েক পাসপোর্ট অফিসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। অফিসকে দালালমুক্ত এবং দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। তিনি নিজেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর পাঠিয়ে দালালদের ধরিয়ে দিতেন।

তাঁর এমন তীক্ষ্ন নজরদারি ও কঠোর ভূমিকায় দালালেরা ভয়ে পাসপোর্ট অফিস ঘেঁষতেন না। অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও থাকতেন তটস্থ। যে কারণে তাঁর সময়ে অফিস ছিলো অনেকটা দুর্নীতি ও দালালমুক্ত। তাঁর চলে যাওয়ার পর পাসপোর্ট অফিসে ফের ভর করেছে দালালচক্র।

সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের সাতসতী গ্রামের মোশাররফ হোসেন জানান, তিনি দালালের মাধ্যমে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে এসেছেন। ওই দালাল ফেনীর একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন।

বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও দালালের উপদ্রব বিষয়ে ফেনীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোক্তার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করে বলেন, তাঁর অফিস সম্পূর্ণ দালাল ও দুর্নীতিমুক্ত। এখানে কাউকে হয়রানি কিংবা কারো কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয় না।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি অব বাংলাদেশ (আটাব) ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও কুমিল্লার আঞ্চলিক আহ্বায়ক বাহার হাজারী বেশির ভাগ ট্রাভেল রেজিষ্ট্রশন না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, ফেনীর এসব ট্রাভেল এজেন্সিগুলো অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সির সদস্য।

পাসপোর্ট প্রদানে পুলিশের প্রতিবেদনের জন্যে টাকা নেয়ার বিষয়ে ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিএসবি শাখার পরিদর্শক সাইফুদ্দীন ভূঞা বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। ডিএসবির নাম করে টাকা নেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।
বাংলারদর্পণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *