ইশরাত ইভা >>
প্রশ্ন জাগে নারী জঙ্গি বাহিনী তৈরি করে হামলার নতুন কৌশলের পাঁয়তারা করছে জঙ্গিরা নাকি নিজেদের পরিবারকে সহযোগী বানিয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আস্তানাকে গোপন রাখার সহজ উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। জঙ্গিরা নিজেদের পরিবারকে কেন্দ্র করে কর্ম তত্পরতা চালু রাখার চেষ্টা করছে। পরিবারকে আস্তানা করার গুটি হিসেবে ব্যবহার কিছুটা হতবাক করার মতো।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে (১৬ মার্চ, ২০১৭) টানা ১৯ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নারীসহ চার জঙ্গি ও এক শিশু নিহত হয়েছে। যে কারণে এই অভিযান বিষয়ে আলোচনার দাবি রাখে তা হচ্ছে আবারো আমরা দেখলাম কোনও নারীর প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়েই পড়া নয় শুধু বরং একটি পরিকল্পিত আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটলো!
এর আগে গত বছর (২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬) তে ঢাকার আশকোনায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অনুরূপ একটি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছিল এবং সেখানেও একজন নারী জড়িত ছিলেন। আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা বা এ জাতীয় জঙ্গি দমন অভিযান নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য আমার এ লেখা নয়; নারীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি।
সুতরাং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে নারীদের জড়িত হবার প্রবণতা যে অতিসম্প্রতি দেখা দিচ্ছে তা আমরা বলতে পারি না, উপরুন্ত বিভিন্ন সময়ে আটক সন্দেহভাজন নারী জঙ্গিদের বিষয়ে এই ধারণাই দেয় যে, জঙ্গিবাদে নারীরা বেশ আগে থেকেই জড়িয়ে পড়ছেন; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন নারীরা কেন, কিভাবে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন??
নারীরা নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় নেমেছেন না স্বামীর চাপে বা সামাজিক কারণে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন??
বিভিন্ন সময়ে কথিত জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃত নারীদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এই তথ্যই মিলে যে, স্বামীর চাপে অসহায় হয়ে তারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন। তবে এর বাইরে অনেক নারী স্বেচ্ছায় যে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন না তা নয়।
যাই হোক নারীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের ভাবিত করে; বিশেষত যেখানে অনেক বিশ্লেষকদের মুখে শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ দীর্ঘসময় পর্যন্ত জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে আছে; সুতরাং বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বিশ্লেষকদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশের জন্য সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি আরও দীর্ঘদিন থাকবে; এই পরিস্থিতিতে এবং অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী নারী জঙ্গি নিহত হবার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, সন্ত্রাসবাদে নারীদের জড়িয়ে যাবার ব্যাপারটি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
বিশ্বের অনেক দেশে আত্মঘাতী হামলায় নারী ও কিশোরদের অংশগ্রহণ নতুন নয়। আফ্রিকার জঙ্গিদল বোকোহারাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে নারী ও কিশোরদের। এমনকি অবুঝ শিশুদের গায়ে সুইসাইডাল বেল্ট জড়িয়ে দিয়ে জনাকীর্ণ এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের নারী আত্মঘাতী বা যোদ্ধার অস্তিত্ব অনেক বেশি ছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে হত্যায় নারী আত্মঘাতীর অংশগ্রহণ বিশেষ উদাহরণ হিসেবেই রয়ে গেছে। বিশ্বের মোট জঙ্গি হামলার শতকরা ১৫ ভাগে নারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেলেও বাংলাদেশে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী শাকিরা প্রথম নারী জঙ্গি আত্মঘাতী হওয়াই জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছে। জঙ্গিবাদে নারীদের সম্পৃক্ততার গভীরতা ও মাত্রা এবং কারণ উদঘাটনে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। হাল্কা ধারণার উপর ভিত্তি করে নারী জঙ্গিদের বিপদ নিয়ে বিশারদদের ছড়ানো শঙ্কা জনমনে অহেতুক ভীতির সৃষ্টি করেছে এবং বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশি জঙ্গিবাদের চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জিহাদি আফিমে আসক্ত মা ও বাবারা নিজ সন্তানদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রতি যত্নবান নয় এবং প্রয়োজনে বলি দিতেও পিছপা হবে না আশকোনার ঘটনা থেকে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নারীদের যোদ্ধা বানানোর খুব একটা প্রয়াস নিতে দেখা যায়নি। জঙ্গিরা জীবনসঙ্গীকে মতাদর্শে অনুরক্ত করে নিজেদের নিরাপদ করতে চেয়েছে। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে পরিবারকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে রেখেছে। তানভীর বা জাহিদের মত শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হবার পরে নিজ স্ত্রীকেও সাথী করে নিতে চেয়েছে। জিহাদি মতাদর্শের চেয়ে পারিবারিক বন্ধনের টান জঙ্গিবাদে নারীদের বেঁধে রাখতে বেশি ভূমিকা রেখেছে। জীবনের মায়া ও সন্তানদের মমতা আত্মসমর্পণে অনুঘটক হলেও সবার ক্ষেত্রে একই প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে নারী জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মাত্রা নিঃসন্দেহে খুবই কম। নিরীহ মানুষের জীবনের হুমকি সৃষ্টিকারী কতিপয় জঙ্গি নির্মূলে পুলিশ বাহিনী সক্ষমভাবে অবদান রেখে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে।
বাংলাদেশ জঙ্গি নিধন হলেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভিন্নভাবে প্রবাহিত হয়। জঙ্গিবাদের প্রতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে। জঙ্গিবাদ বিষয়ে রাজনীতির মতপার্থক্য প্রকারান্তরে জঙ্গিবাদকে সুরক্ষা দেয় এবং উত্সাহিত করে। নারী জঙ্গি বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে তেমন ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক খুলনার কন্ঠ।